Friday, February 25, 2022

ভাষা আন্দোলনের সে সময়ে সংবাদপত্রের ভূমিকা । (সংক্ষেপে)

ভাষা আন্দোলনের সে সময়ে সংবাদপত্রের ভূমিকা । (সংক্ষেপে) 


নাছরিন আক্তার

পাকিস্তান সৃষ্টির আগেই বিতর্কের সূত্রপাত হয়। ‘বাংলা’ নাকি ‘উর্দু’—কী হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা! পাকিস্তান সৃষ্টির পর বিষয়টি পূর্ব বাংলার সবচেয়ে আলোচিত ও বিতর্কিত প্রশ্নে রূপ নেয়। তখনকার সংবাদপত্রে এই বিতর্কের প্রতিফলন লক্ষ করা যায়। সংবাদপত্রগুলো পক্ষে-বিপক্ষে নানা প্রবন্ধ, নিবন্ধ ও সংবাদ প্রকাশ করে ভাষার ইস্যুটিকে গুরুত্বপূর্ণ করে তোলে। 


এ সময় কলকাতা থেকে প্রকাশিত মুসলিম লীগ-সমর্থক পত্রিকাগুলোয় পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা নির্ধারণ প্রসঙ্গে বেশ কিছু প্রবন্ধ ছাপা হয়। বাংলা ভাষার পক্ষে তখন প্রশংসনীয় ভূমিকা পালন করে দৈনিক ইত্তেহাদ। দৈনিক আজাদও বাংলা ভাষার সমর্থনে বেশ কিছু প্রবন্ধ ছাপায়।

প্রথম থেকেই মর্নিং নিউজ বাংলা ভাষার তীব্র বিরোধিতা করে আসছিল। ভাষা আন্দোলনের বিরোধিতা করে পত্রিকাটিতে অব্যাহতভাবে। প্রবন্ধ, নিবন্ধ, সম্পাদকীয়, উপসম্পাদকীয় ও খবর প্রকাশিত হতো। ১৯৪৭ সালে ১৭ ডিসেম্বর মর্নিং নিউজের সম্পাদকীয় কলামে উর্দু-সমর্থকদের একটি তাত্ত্বিক বক্তব্য প্রকাশিত হয়।


পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকে বাংলা ভাষার প্রতি পাকিস্তান সরকারের একচোখা নীতির বিষয়ে তমদ্দুন মজলিসের কয়েকজন নেতা তৎকালীন মন্ত্রী ফজলুর রহমানের সঙ্গে আলোচনা করতে যান। মন্ত্রী এসব বিষয়কে ‘অনিচ্ছাকৃত ভুল’ বলে দায় এড়ান। তাঁর এই বক্তব্যের ওপর ইত্তেহাদ ‘ভুলের পুনরাবৃত্তি’ শীর্ষক সম্পাদকীয় প্রকাশ করে।


১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান গণপরিষদের প্রথম অধিবেশন শুরু হয়। অধিবেশনে পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিনিধি ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত উর্দু ও ইংরেজির সঙ্গে বাংলাকে গণপরিষদের অন্যতম ভাষা হিসেবে ব্যবহার করার দাবি তোলেন। ১৯৪৮ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি আনন্দবাজার পত্রিকা এবং ২৭ ফেব্রুয়ারি অমৃত বাজার পত্রিকা এই খবর প্রকাশ করে।


১৯৪৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে গণপরিষদে খাজা নাজিমুদ্দিন বলেছিলেন, পূর্ব পাকিস্তানের অধিকাংশ অধিবাসীর মনোভাব রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উর্দুর পক্ষে। তাঁর বক্তব্যের তীব্র প্রতিবাদ করে ১৯৪৮ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি দৈনিক আজাদ সম্পাদকীয় প্রকাশ করে। সম্পাদকীয়র বক্তব্য বাংলা ভাষার পক্ষে পত্রিকাটির জোরালো সমর্থন নির্দেশ করে। কিন্তু একই বছর মার্চ মাসে ভাষা আন্দোলনের সময় পত্রিকাটি সর্বতোভাবে উর্দুকেই সমর্থন করে।


কয়েকটি পত্রিকা সক্রিয়ভাবে ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে। ভাষা আন্দোলনকে সাংগঠনিক রূপ দিতে ১৯৪৮ সালের ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলে গঠিত হয় সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ। সংগ্রাম পরিষদে ‘ইনসাফ’, ‘জিন্দেগী’ ও ‘দেশের দাবী’ পত্রিকা থেকে তিনজন করে প্রতিনিধি নেওয়া হয়।


১৯৫১ সালের ১১ মার্চ রাষ্ট্রভাষা দিবস উপলক্ষে সংগ্রাম পরিষদের পুরোনো কমিটি পুনর্গঠন করে ‘বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ গঠন করা হয়। ১৯৫২ সালের ৩১ জানুয়ারি গঠন করা হয় সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ। ৪ ফেব্রুয়ারি সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ২১ ফেব্রুয়ারি পূর্ব বাংলায় সাধারণ ধর্মঘটের ডাক দেয়। ২০ ফেব্রুয়ারি সরকার ৩০ দিনের জন্য শহরে ১৪৪ ধারা জারি করে। 


১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি সকালেই ছাত্রছাত্রীতে পূর্ণ হয়ে যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণ।  একপর্যায়ে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের ঘোষণা আসে। স্লোগান ওঠে, ‘১৪৪ ধারা ভাঙতে হবে’, ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’। হাবিবুর রহমান শেলীর নেতৃত্বে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করেন একদল ছাত্রছাত্রী। এরপর দফায় দফায় পুলিশের সঙ্গে ছাত্রদের সংঘর্ষ হয়। বিকেলে পরিস্থিতির চরম অবনতি ঘটে। ছাত্রজনতার ওপর নির্বিচারে গুলিবর্ষণ করে পাকিস্তানি মদদপুষ্ট পুলিশ। শহীদ হন সালাম-বরকত-রফিকসহ নাম না-জানা অনেকেই।


২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় গুলিবর্ষণের ঘটনার পর ভাষার প্রশ্নে আগের রহস্যের জাল ছিন্ন করে দৈনিক আজাদ। এদিন সন্ধ্যায় দৈনিক আজাদ প্রকাশ করে বিশেষ টেলিগ্রাম। ব্যানার হেডলাইন করা হয়, ‘ছাত্রদের তাজা খুনে ঢাকার রাজপথ রঞ্জিত’। মুসলিম লীগ সরকার দৈনিক আজাদের এই সংখ্যা বাজেয়াপ্ত করে। পুলিশের গুলিবর্ষণের প্রতিবাদে আজাদ সম্পাদক আবুল কালাম শামসুদ্দীন প্রাদেশিক পরিষদ থেকে পদত্যাগ করেন। ঘটনার প্রতিক্রিয়া নিয়ে পরবর্তী কয়েক দিন দৈনিক আজাদ প্রচুর সংবাদ ছাপে। ভাষা আন্দোলনের পক্ষে সোচ্চার ভূমিকা নেয়।


মর্নিং নিউজ ছিল উর্দু ভাষার সমর্থক। পত্রিকাটি ভাষা আন্দোলনের বিরুদ্ধে মিথ্যা ও উগ্র প্রচারণা চালায়। ২১ ফেব্রুয়ারির ঘটনাকেও তারা বিকৃত করে ২২ ফেব্রুয়ারি খবর প্রকাশ করে। ২২ ফেব্রুয়ারি বিক্ষুব্ধ জনতা ভিক্টোরিয়া পার্কের কাছে অবস্থিত মর্নিং নিউজের প্রেস ও অফিস জ্বালিয়ে দেয়। 


সংবাদে কর্মরত অধিকাংশ সাংবাদিকই ছিলেন বাংলা ভাষার সমর্থক। কিন্তু মালিকানার কারণে পত্রিকাটি ভাষা আন্দোলনের বিরোধিতা করছিল। ২১ ফেব্রুয়ারির খবরও পত্রিকাটি খুব কম গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ করে। ২২ ফেব্রুয়ারি ক্ষুব্ধ জনতা রথখোলা মোড়ে সংবাদ অফিসে হামলা চালায়। ভাষা আন্দোলনবিরোধী ভূমিকার জন্য পত্রিকাটি থেকে তরুণ সাংবাদিক মুস্তফা নূরউল ইসলাম ও ফজলে লোহানী পদত্যাগ করেন।

ভাষা আন্দোলনের বিভিন্ন খবর পাকিস্তান অবজারভার পত্রিকায় গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশিত হতো। এ কারণে পাকিস্তান সরকার ১৯৫২ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি অবজারভারের প্রকাশনা বন্ধ করে দেয়। সম্পাদক আবদুস সালাম ও মালিক হামিদুল হক চৌধুরীকে গ্রেপ্তার করা হয়।


সাপ্তাহিক সৈনিক ২১ ফেব্রুয়ারি বের করে বিশেষ সংখ্যা। পত্রিকাটি লাল কালিতে ব্যানার করে, ‘শহীদ ছাত্রদের তাজা রক্তে ঢাকার রাজপথ রঞ্জিত, মেডিক্যাল কলেজ হোস্টেলে ছাত্র সমাবেশে পুলিশের নির্বিচারে গুলিবর্ষণ’। ২৩ ফেব্রুয়ারি রাতে পুলিশ সৈনিক অফিস ঘেরাও করে। সম্পাদক আবদুল গফুর ও প্রকাশক প্রিন্সিপাল আবুল কাশেমকে গ্রেপ্তার করা হয়।


ভাষা আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে দৈনিক মিল্লাত, দৈনিক ইনসাফ ও দৈনিক আমার দেশ। ২১ ফেব্রুয়ারির ঘটনায় দৈনিক মিল্লাত ব্যানার শিরোনাম করে: ‘রাতের আঁধারে এত লাশ যায় কোথায়?’। ঘটনার পর মিল্লাত সম্পাদক মো. মোদাব্বেরের নামে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়। ভাষা আন্দোলনে সাপ্তাহিক ইত্তেফাকও জোরালো ভূমিকা পলন করে।

Tuesday, February 22, 2022

কবি রকিবুল হাসানের লেখা কবিতা "শেকড়ের ছবি"

শেকড়ের ছবি




রকিবুল হাসান

তোমার সুখের প্রত্যেকটি চাবুকের ঘা এসে আমার বুকে লাগে

আমি হাসি;

নরম মাটির মতো পেতে দিই নিজেকে- তোমাকে ভালোবাসি।


কবিতায় অবজ্ঞা ও অবহেলা সযত্নে বাঁধাই করে রাখি

শব্দ খুলে খুলে তোমাকে দেখি;

নির্ঘুম জীবন ক্যানভাসে তোমার ছবিই আঁকি।


তোমার উপেক্ষা কখনো আমাকে করেনি উজান ঢেউ

একটুও জমিন নেই-নি:স্ব আমি;

শুধু বুকটুকু আছে-তার সবটুকু সুবাসিত ঘ্রাণ তুমি। 


ভালোবাসার আদরে দারুণ কৌশলে যতবার দাও 

বিষের পেয়ালা;

গহিন তৃষ্ণায় পান করি আশ্চর্য সমুদ্রসুখ জীবনবেলা।


কতোটা ভালোবাসলে ভালোবাসা হয়-অংকটা জানিনি 

শেকড়টা ধরে রাখি;

শেকড়ই যে বুকে-পিঁঠে শৈল্পিক ছবি অবজ্ঞা ও অপমানের।


মিরপুর, ঢাকা

আট. দুই. বাইশ

Sunday, February 20, 2022

ফারহানা হৃদয়িনী'র লেখা কবিতা বাংলায় ডাকি মা



 *বাংলায় ডাকি মা*



           ফারহানা হৃদয়িনী 


আমি বাংলায় ডাকি মা,

বাংলা মায়ের মধুর ভাষার হয় কি তুলনা?

এই ভাষাকে কাড়তে চেয়েছিল পাকিস্থানী হায়েনা,

ওরা বোঝেনি বাঙালী অন্যায় মানেনা।

অকাতরে প্রাণ বিলিয়ে দিতে, বাঙালীর নাই কোন তুলনা।

ঊনিশশো বায়ান্নো সালের একুশের সেই রক্তঝরা দিনে,

প্রকৃতিতে ছিলো ফাগুন, আর কন্ঠে ঝরেছে আগুন।

স্বাধীকারের দাবীতে রাজপথে নেমেছিলো ছাত্র জনতা মিলে,

বাংলাভাষার দাবীতে রাজপথের মিছিলে।

রাষ্ট্র ভাষা, রাষ্ট্র ভাষা; বাংলা চাই, বাংলা চাই,

মুখের ভাষা না পেলে যে, আজ ঘরে ফেরার উপায় নাই।

রফিক, শফিক, জব্বার, বরকত, সালাম,

আরো নাম না জানা কত দেশ প্রেমিকের নাম।

বাংলা ভাষার জন্য যারা দিয়ে গেছে প্রাণ,

তাদের রক্তে অর্জিত বাঙালীর সম্মান।

সারা বিশ্বে বাঙালীর জয়গান,

এতো সেই ভাষা শহীদদের অবদান।

স্মৃতির মিনারে শহীদদের স্মৃতি রবে চির অম্লান,

আমরা বাঙালী  দিয়ে যাব চিরকাল তাদের মান।

Friday, February 11, 2022

বঙ্গবন্ধু উপাধি (ফারহানা হৃদয়িনী)

 বঙ্গবন্ধু উপাধি 

📝ফারহানা হৃদয়িনী




ইতিহাস আজীবন কথা বলে। ইতিহাস মানুষকে ভাবায়, তাড়িত করে। বাঙালী জাতির ইতিহাসে স্বর্ণখচিত নাম, ইতিহাসের এক আলোকিত মহামানব  শেখ মুজিবুর রহমান। যে নামটি বাঙালীর হৃদয়ে, বাঙালীর রক্তে, শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা হয়ে মিশে গেছে। বিশ্বের ইতিহাসে যার সাহস ও বীরত্বের গাঁথা চিরকাল অমলীন হয়ে থাকবে।

 বাঙালী জাতির ইতিহাসে আশীর্বাদের দিন ছিলো ১৯৬৯ সালের ২৩শে ফেব্রুয়ারী। যেদিন শেখ মুজিবুর রহমান  ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি লাভ করেন

''১৯৬৯ সালের ২৩শে ফেব্রুয়ারি পল্টনে তাঁকে 'বঙ্গবন্ধু' উপাধি দেয়ার মধ্যে দিয়ে প্রমাণিত হয় জনগণের কত কাছাকাছি তিনি চলে এসেছেন। এটা ছিলো একটি রাজনৈতিক পালাবদলের নমুনা। কারণ এই বঙ্গবন্ধু উপাধি দেয়ার মাধ্যমে তিনি হয়ে উঠলেন জনগণের অবিসংবাদিত নেতা।

১৯৬৮ সালের ছাত্রসংসদের নির্বাচনী প্রচার উপলক্ষ্যে ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগ নভেম্বর মাসে চার পাতার একটা প্রচারপত্র প্রকাশ করে। এর নাম ছিল ‘প্রতিধ্বনি’, সম্পাদক আমিনুর রহমান। শেষের পাতায় দুটো লেখা ছিল, দুই কলামে। প্রথম কলামে ছিল ছাত্র সংসদের পক্ষ থেকে একটা বিবৃতি। শিরোনাম ছিল ‘কর্মমুখর অতীতের স্বাক্ষর’। এতে বিগত ছাত্রসংসদের কর্মকাণ্ডের একটা ফিরিস্তি ছিল। দ্বিতীয় কলামে ছিল ছয় দফা কর্মসূচির বর্ণনা।

ঢাকা কলেজ শাখা ছাত্রলীগ প্রকাশিত বুলেটিন ‘প্রতিধ্বনি’র শেষ পৃষ্ঠায় ‘বঙ্গবন্ধু’ শব্দের প্রথম ব্যবহার হয়। এর শিরোনাম ছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক প্রস্তাবিত পূর্ব বাংলার ‘মুক্তি সনদ’ ছয় দফা। ‘বঙ্গবন্ধু’ দুই শব্দের আলাদা করে ছাপা হয়েছিল। শেখ মুজিবের জন্য এই উপাধির আবিষ্কর্তা ছিলেন ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের নেতা এবং ওই সময়ে ঢাকা নগর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক রেজাউল হক মুশতাক। তাঁর চিন্তা ছিল দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের মতো একটা জুতসই কিছু শেখ মুজিবের জন্য খুঁজে বের করা। এই ভাবনা থেকেই বঙ্গবন্ধু শব্দের উৎপত্তি। বিষয়টি একসময় সিরাজুল আলম খানের কানে যায়। তিনি এটা ‘অনুমোদন’ করেন।

১৯৬৮ সালের জানুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার অভিযোগ আনে, শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে কয়েকজন রাজনৈতিক, সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তা এবং গুটিকয় সাধারণ সৈনিক সশস্ত্র অভ্যুত্থানের মাধ্যমে পূর্ববাংলাকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিলেন। এই মিথ্যা মামলায় শেখ মুজিবুর রহমানসহ মোট ৩৫ জনকে আসামি করা হয়। ৩৫ জন আসামির সবাইকে পাকিস্তানি সরকার গ্রেফতার করে।

মিথ্যা মামলায় শেখ মুজিবুর রহমানকে সাজা দেওয়ার পরিকল্পনা টের পেয়ে বাঙালি জাতি ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে এবং স্বৈরাচারী আইয়ুবের বিরুদ্ধে গণপ্রতিরোধ গড়ে তোলে। ছাত্র-জনতার মিছিলে রাজপথ উত্তাল হয়ে ওঠে। গণআন্দোলনে নতিস্বীকার করে আইয়ুব খান আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করে শেখ মুজিবুর রহমানসহ অভিযুক্ত সব আসামিকে মুক্তি প্রদানের ঘোষণা দেন। ২৩ ফেব্রুয়ারি কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে রমনার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) বিশাল গণসংবর্ধনার আয়োজন করা হয় এবং ওই সভায় তৎকালীন ডাকসুর সভাপতি, বঙ্গবন্ধুর একনিষ্ঠ সহচর তোফায়েল আহমেদ শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করেন। বাংলার জনগণের কাছে শেখ মুজিবুর রহমান নাম ছাপিয়ে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিটি ক্রমেই জনপ্রিয় হয়ে উঠতে থাকে।

রাজনীতিতে শেখ মুজিবের একচেটিয়া ভাবমূর্তি প্রতিষ্ঠার পথে ‘বঙ্গবন্ধু’ শব্দটি বিরাট ভূমিকা রেখেছিল। এটা পরবর্তী সময়ে তাঁর নামের অপরিহার্য অংশ হয়ে যায়।

১৯৭১ সালের ৩ মার্চ  তিনি জাতির জনক উপাধি লাভ করেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে 'জাতির জনক' উপধি দেন মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব /সংগঠক এবং তৎকালীন ডাকসু ভিপি জনাব আ.স.ম. আব্দুর রব। 

শেখ মুজিবুর রহমানের বজ্রকণ্ঠ ১৯৭১ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি জনগোষ্ঠিকে মুক্তি ও স্বাধীনতার পথ নির্দেশনা দিয়েছিল।

"...মনে রাখবা- রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেব, এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাল্লাহ। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম- এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা।" ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ ঢাকার রেস কোর্স ময়দানের এক জনসভায় এই বজ্রঘোষণার মাধ্যমে শেখ মুজিব স্বাধীনতার ডাক দিয়েছিলেন এবং জনগণকে সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলনের জন্য প্রস্তুত করেছিলেন।

  শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম ১৯২০ সালের ১৭ই মার্চ গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায়। তার বাবা শেখ লুৎফর রহমান ছিলেন গোপালগঞ্জ দায়রা আদালতের সেরেস্তাদার এবং মা সায়েরা খাতুন।

ছয় ভাইবোনের মধ্যে তিনি ছিলেন তৃতীয় সন্তান। ১৯২৭ সালে শেখ মুজিব গিমাডাঙ্গা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা শুরু করেন তাঁর সাত বছর বয়সে।

খুবই অল্প বয়সে তিনি বিয়ে করেছিলেন সম্পর্কে আত্মীয় বেগম ফজিলাতুন্নেসাকে।

নয় বছর বয়সে তিনি ভর্তি হন গোপালগঞ্জ পাবলিক স্কুলে এবং পরে ম্যাট্রিক পাশ করেন গোপালগঞ্জ মিশনারি স্কুল থেকে।

গোপালগঞ্জ মিশনারি স্কুলে পড়ার সময় ১৯৩৯ সালে স্কুল পরিদর্শনে গিয়েছিলেন তৎকালীন বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির মুখ্যমন্ত্রী এ কে ফজলুল হক এবং পরবর্তীতে বাংলার প্রধানমন্ত্রী ও পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালনকারী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। কাশ্মিরী বংশোদ্ভুত বাঙালি মুসলিম নেতা মি.সোহরাওয়ার্দী পরবর্তীকালে শেখ মুজিবের রাজনৈতিক জীবনকে গভীরভাবে প্রাভাবিত করেছিলেন।

উনিশশ' ৪২ সালে এট্রান্স পাশ করার পর শেখ মুজিব ভর্তি হন কলকাতা ইসলামিয়া কলেজে যেটির বর্তমান নাম মাওলানা আজাদ কলেজ। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত এই কলেজটি তখন বেশ নামকরা ছিল। এই কলেজ থেকে তিনি সক্রিয়ভাবে ছাত্র রাজনীতি শুরু করেন।

তবে স্কুল জীবন থেকেই তিনি তাঁর নেতৃত্ব দেবার দক্ষতা প্রমাণ করেছেন। 

তিনি ১৯৪৩ সালে যোগ দেন বেঙ্গল মুসলিম লীগে এবং ১৯৪৪ সালে বর্তমান বাংলাদেশের কুষ্টিয়ায় অনুষ্ঠিত নিখিল বঙ্গ মুসলিম ছাত্র লীগের সম্মেলনে যোগদানের মধ্যে দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে রাজনীতিতে অভিষিক্ত হন।