ছোট গল্প
শ্রাবণ-সন্ধ্যা
ফারহানা হৃদয়িনী
খুব তাড়াতাড়ি ঈদের ছুটি হয়ে যাবে তাই দুজনকেই নিজ নিজ গ্রামের বাড়িতে ফিরতে হবে, ওরা দুজন ঠিক করেছে বাড়িতে যেয়ে বাবাকে জানাবে, যেন দু পক্ষের গার্জিয়ানরা মিলে ওদের বিয়ের কবিনটা করে দেয়।
সন্ধ্যা অনেক ঘুরে ঘুরে সস্তার একটি ফ্ল্যাট খুঁজে ভাড়া নিলো। আপাতত শ্রাবণই সেখানে উঠবে। আর ঈদের পরে গার্জিয়ানদের দোয়া নিয়ে দুজনে একসাথে সেখানে থাকা শুরু করবে।
শ্রাবণ চাকরীতে চলে যায়, আর সন্ধ্যা সারাদিন বাজারে ঘুরে ঘুরে সংসার সাজানোর টুকি টাকি জিনিস কিনে ঘর সাজিয়ে চলে। তার স্বপ্ন সাধনার সংসার সে মনের মাধুরী দিয়ে সাজিয়ে চলে।
সন্ধ্যা পড়ালেখার পাশাপাশি তিনটি টিউশনি করে। সেটার টাকা দিয়েই সে সংসারের নানা জিনিস কিনে চলে।
সন্ধ্যা: এই শ্রাবণ সামনের ঈদে আমাকে কিন্তু একটি শাড়ি কিনে দিতে হবে।
শ্রাবণ: ভালো একটি চাকরী পেলেই তোমাকে দশটি শাড়ি কিনে দিবো।
সন্ধ্যা: সাধারনই একটা কিনে দাও। হুট করে বিয়ে হলো তাই বিয়ের কোন শাড়ি হলোনা। একটা সাধারন শাড়িই কিনে দাও।
শ্রাবণ: আচ্ছা দিবো
দিবো বলেও শ্রাবণ ঠিকই শাড়ি কেনার কথা ভুলে গেলো।
সন্ধ্যার মনে একটু একটু অভিমান জমেছে, সব প্রেমিকরাই তাদের প্রেমিকাকে কত কিছু গিফট করে আর ওতো এখন শ্রাবণের স্ত্রী, সবাই না জানলেও তো ওরা দুজন জানে। তাই শ্রাবণের উপর একটু দাবী তো সে রাখতেই পারে। তাই জোর করেই শ্রাবণের কাছ থেকে ঈদে একটা শাড়ি কিনলো।
ইদানিং শ্রাবণ কেমন যেন একটু একটু বদলে যাচ্ছে, আগের মত আর সন্ধ্যার কাছে ফোন করেনা, সন্ধ্যার খবর নেয়না, শুধু নানা কাজের অজুহাত দেখিয়ে সন্ধ্যাকে এড়িয়ে চলে। তবু সন্ধ্যা বিশ্বাস করে হয়তো শ্রাবণের কাজের চাপ বেড়েছে। নতুন বাসাটি সন্ধ্যার হোষ্টেল থেকে দূরে হওয়াতে দেখা সাক্ষাতটাও বেশ কমে গেছে।
আজ একটা টিউশনিতে যেতে হবেনা, ছাত্ররা বেড়াতে গেছে তাই সন্ধ্যা ভাবলো শ্রাণের সাথে দেখা করা যায়। সেই জন্য সে শ্রাবণ কে ফোন করলো। শ্রাবণ বার বার ফোন কেটে দিচ্ছে। বিজি বিজি বিজি
সন্ধ্যা: বার বার ফোন করছে আর বিজি পাচ্ছে, সন্ধ্যার প্রচন্ড রাগ হচ্ছে, কি এমন জরুরী কথা হচ্ছে। প্রচন্ড রাগ নিয়েই সে শ্রাবণের ফ্ল্যাটের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লো।
যেয়ে দেখে বাসা বন্ধ তাই সে শ্রাবণের ফ্ল্যাটের অদূরে জারুল গাছের তলায় বসে শ্রাবণের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলো। একটু পরেই শ্রাবণ এলো মোটর সাইকেল চালিয়ে। পেছনে বসে আছে ওর বান্ধবী অর্পা।
অর্পার সাথে শ্রাবণের বহুদিনের বন্ধুত্ব। খুবই মডার্ণ মেয়ে সে। তার জীবনে ছেলে বন্ধুর কোন অভাব নেই। কিন্তু শ্রাবণের মোটর সাইকেলে চেপে তার ফ্ল্যাটের সামনে এসে নামার রহস্য ঠিক সন্ধ্যার মনোপুত হলোনা।
শ্রাবণ হঠাৎ সন্ধ্যাকে দেখে হকচকিয়ে গেলো। সন্ধ্যা কিছু না বলেই বড় অভিমানে আর প্রচন্ডক্ষোভে সেখান থেকে চলে আসলো।
তারপর দুদিন আর ফোন করেনি শ্রাবণকে, আর শ্রাবণও ফোন দেয়নি সন্ধ্যাকে। ইদানিং সন্ধ্যায় বেশী ফোন করে শ্রাবণকে, শ্রাবণ খুব একটা ফোন করেনা ওকে। সন্ধ্যা দুদিনের বেশী রাগ করেও থাকতে পারেনা।
শ্রাবণের কথা বার বার মনে হচ্ছিল তাই, ওকে ফোন দিলো। অনেকক্ষণ পর শ্রাবণ ফোন ধরলো। শ্রাবণ ওপাশ হতে বললো
শ্রাবণ: এই কুত্তা খবরদার আর কোনদিন আমাকে ফোন করবিনা।
সন্ধ্যা: তুমি আমাকে গালি দিচ্ছো!!
তুমি আমাকে এমন বিশ্রীভাবে গালি দিতে পারলে?
সন্ধ্যার পায়ের নীচের জমিন যেনো ভূমিকম্পে ধ্বসে গেলো।
যে মানুষটিকে যে জীবন দিয়ে ভালোবেসেছে আজ তার একি ব্যাবহার। যাকে অন্তর দিয়ে ভালোবাসা যায় তার একটু খানি খারাপ ব্যাবহারে অন্তর ভেঙে গুড়িয়ে যায়। কি করবে সন্ধ্যা কানতে কানতে ফোন রেখে দিলো। ভাঙা মন নিয়েই দুদিন পরে ঈদ করতে বাড়ি চলে গেলো।
বাড়িতে যেয়ে অনেক মাফ চেয়ে চেয়ে ম্যাসেজ লিখে লিখে শ্রাবণকে পাঠালো তাও শ্রাবণের কোন রিপ্লাই পেলোনা। এভাবেই প্রচন্ড মন খারাপের সময় পার হয়ে গেলো, ঈদ শেষে আবার ঢাকায় ফিরে এলো।
অনেকক্ষণ রিং বাজছে, তাকিয়ে দেখে অর্পার ফোন, সেদিনের পর থেকে অর্পাকে সন্ধ্যার বিষের মত লাগে, একদমই সহ্য করতে পারেনা সে। তবু ফোন ধরলো।
অর্পা: হ্যালো শ্রাবণ কেমন আছিস?
সন্ধ্যা: কেমন আর থাকতে পারি?
অর্পা: হা তোর বিষয়টা বুঝি
সন্ধ্যা: সত্যিই যদি বুঝতি তাহলে বান্ধবীর স্বামীর সাথে ঘুরে বেড়াতিনা।
অর্পা: কথা শুনে হেসে গড়িয়ে পড়লো।
সন্ধ্যা: হাসছিস কেনো?
অর্পা: তোর মত বেকুব বৌ শ্রাবণের আর দু চারটি হলোনা তাই হাসছি।
সন্ধ্যা: আমার কিন্তু ভীষন রাগ হচ্ছে।
অর্পা: এত রাগের কি আছে? তুই কি শ্রাবণের কাবিন করা বৌ নাকি?
সন্ধ্যা: মানে কি?
অর্পা : শ্রাবণের সত্যিকারের বৌকে নিয়ে এসেছে দেশের বাড়ি থেকে।
সন্ধ্যা: কি বলিস এসব?
অর্পা: সত্য কথাই বলছি, ওর ফ্ল্যাটে যেয়ে দেখ।
প্রচন্ড ব্যাথায় কুঁকড়ে যেয়ে সন্ধ্যা ফোন কেটে দিলো। তারপর আবার শ্রাবণের অন্যান্য বন্ধুদের ফোন দিলো, জানলো ঠিক কথাই শ্রাবণ গ্রামের বাড়ি হতে বিয়ে করে ফিরেছে। সন্ধ্যার স্বপ্ন সাধের গোছানো ফ্ল্যাটে সেই নতুন বৌকে নিয়ে উঠেছে। প্রচন্ড দুখ কষ্টে সন্ধ্যা জ্ঞান হারালো।
কেমন করে শ্রাবণ এতটা পর হয়ে গেলো ভেবেই পায়না সন্ধ্যা, এতটা নিষ্ঠুর এতটা পাষাণ মানুষ কেমন করে হয়। সন্ধ্যার পবিত্র ভালোবাসাকে শ্রাবণ কেমন করে দুপায়ে মাড়িয়ে দিতে পারলো? একটি বারও সন্ধ্যার কথা কি তার মনে পড়েনা? ওই ফ্ল্যাট যেখানে সন্ধ্যার সকল স্বপ্নের আলপনা ছড়ানো, সেখানেই সে দিব্যি নতুন বৌকে নিয়ে বাস করছে, একবার ভুলেও সে সন্ধ্যার খবর নিলো না।
আজ বিবাহবার্ষিকীর দিন সন্ধ্যা শ্রাবণের দেওয়া শাড়িটি পরে, ওর ফ্ল্যাটের কাছের গাছগুলির নীচে এসে বসে আছে। আর দূর থেকে তাকিয়ে আছে তার সেই ভেঙে যাওয়া স্বপ্নের মন্দিরের দিকে। যেখানে তার প্রেমের তার ভালোবাসার দেবতা বাস করে। হয়তো সন্ধ্যার সাথে বিয়েটা শ্রাবণের কাছে পুতুল খেলার মতই ছিলো কিন্তু সন্ধ্যা তাকে হৃদয়ের গভীরে স্থান দিয়েছিলো। আজ সন্ধ্যা গোধুলী লগ্নে গাছের নীচে বসে কাঁদছে আর শ্রাবণের কথা ভাবছে, তার অনুভবের পরতে পরতে যে মানুষটি মিশে আছে তাকে সে কেমনে ভুলে যাবে? কোনদিন যেমন তার দেওয়া ভালোবাসা গুলো ভোলা সম্ভব না তেমনি তার বিশ্বাসঘাতকতাও ভোলা সম্ভব না। দুচোখ দিয়ে শুধুই ঝরে অবিরল অশ্রুর শ্রাবণ। এক জীবনের প্রেমের এই পরম পাওয়া।
সবার জীবনের গল্পের শেষ লাইন গুলি সুন্দর হয় না, কিছু প্রশ্ন জমে থাকে জীবনের বাঁকে। আজ শ্রাবণের অশ্রুসিক্ত মনে নানা কথার আনাগোনা আর প্রচন্ড কষ্ট বুকের ভীতর দলা পাকিয়ে জমাট হয়ে আছে, শুধু অশ্রু গুলিই গলে পড়ছে বার বার। মাথার উপরের আকাশ ঢেকে আছে লাল কৃষ্ণচূড়া আর নীল জারুলে, শ্রাবণের অশ্রুভরা চোখে লাল-নীল সব রঙ ঝাপসা লাগছে। আচ্ছা চোখের জলের কি কোন রঙ থাকতে নেই?
No comments:
Post a Comment
Thank u very much