Sunday, August 1, 2021

শরীফ আহমেদের লেখা গল্প ঃ ভুবন বিনাশী অবরোধ

 


ভুবনবিনাশী অবরোধ 

শরীফ আহমেদ 


মাথাটা টনটন করছে। মনে হচ্ছে একটা বেলুনের মতো প্রচণ্ড চাপ মাথার চামড়াগুলোতে। মনে হচ্ছে ফেটে যাবে সেই চাপে। যেমন করে বেলুন ফেটে যায়।
বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায় মনির। নীরব রাস্তা। খুব কড়া লকডাউন চলছে। তার মাথার চাপ আরও বাড়ে। চলে আসে রুমের ভেতরে।
মাথাটা ব্যথা করে প্রচণ্ড। নিশ্চয়ই মনের মধ্যে কোনো দুশ্চিন্তা ফুঁসে উঠছে। সেজন্যই মাথার চাপ বাড়ছে। সেজন্যই ব্যথা করতে শুরু করেছে মাথা। দুশ্চিন্তাটাকে সে প্রাণপণে ফেরাতে চায়। 
মনে মনে বিড়বিড় করে, সব ঠিক আছে। সব ঠিক আছে। সব ঠিক আছে। সব ঠিক মতো চলছে। সব ঠিক মতো চলছে। সব ঠিক মতো চলছে।
কিন্তু ব্যথাটা কমতে চায় না। মাথার চাপ কমার আগেই দুশ্চিন্তাটা স্পষ্ট হয়। দোকানের ভাড়া দিতে হবে। গত মাসের ভাড়া দিয়ে হাতে কিছু নাই। সংসার চালানোই কঠিন। তার উপর এই মাসও শেষ হবে আগামীকাল। অথচ হাতে তেমন কোনো টাকা আসেনি এখনো। 
সাতদিন ধরে লকডাউনে দোকান বন্ধ। আরও নাকি সাতদিন বন্ধ থাকবে। 
বাসা ভাড়াও দিতে হবে ১০ তারিখের মধ্যে। কীভাবে কী করবে?
গতবছর দুই মাস লকডাউনের পর থেকে সব হিসাব গোলমাল হয়ে যায়। তখন একেবারেই কোনো বেচাকেনা হয়নাই। দোকানই খুলতে পারেনাই। দুইটা কর্মচারী দোকানে। লকডাউনের দুইমাস বেতন না দিলেও বছরের বাকি মাস ঠিকই বেতন দিতে হয়েছে। লকডাউনে ঢাকার স্টুডেন্টরা সব ঢাকার বাইরে চলে গেছে। কে শিখবে কম্পিউটার? কে আসবে কম্পিউটারে টাইপ করাতে? কে আসবে প্রিন্ট করাতে?
বছরখানেক ধরে ধুঁকে ধুঁকে চলছে ব্যবসাটা। তবুও সে ব্যবসায়ি। ব্যবসায়ি মানেই ধনী। কিন্তু লকডাউনের অবরোধ যে ব্যবসায়িকে নিঃস্ব করতে পারে, তা কে বুঝবে? আর শুধু এই অবরোধ কেন? অবরোধ আসার আগেও কি ব্যবসা ভালো ছিলো? গত ১০ বছর ধরে দেশের অর্থনীতিতে গতি নেই। সব ব্যবসায়ই মন্দা।

ড্রয়িং রুমে সোফায় বসে মনির। ডান চোখের ডানপাশটায় নক দিয়ে চুলকাতে গেলে কী যেন একটা কেটে যায়। জ্বালা করে খুব। আবার আঙুল দিয়ে ছুয়ে দেখে জায়গাটা। একটা ফুসকুড়ি হয়েছে। সেটা কেটেই যন্ত্রণা। একদকে ভালোই হয়েছে। এই চোখের পাশের জ্বালা আর ফুসকুড়ির দিকে চিন্তাটা সরে গিয়ে মাথার চাপটা কমে একটু।
সে দক্ষিণের জানালা দিয়ে বাইরে তাকায়। বাতাস আসছে। চারপাশ শুকনা। বৃষ্টি নাই দুইতিন দিন ধরে।
বৃষ্টিহীন শুকনো রাস্তা। দুইপাশের দোকানগুলো বন্ধ। বারান্দায় আবার দাঁড়ায় মনির। ধুঁ ধুঁ শূন্যতায় ভরে উঠে মনের সবটুকু খালি জায়গা। এখানে স্বপ্ন নাই কোনো। স্বপ্নের জন্য কোনো জায়গা খালি নাই। সব স্বপ্ন মরে গেছে ভুবনবিনাশী অবরোধে।

পরদিন হাঁটতে হাঁটতে পল্লবী শপিং কমপ্লেক্সে যায় মনির। খোঁজখবর নেয়। মার্কেট কবে খুলবে। দোকান কবে খোলা যাবে, সেটা বোঝার চেষ্টা করে। 
মার্কেটের সিকিউরিটি গার্ডের সাথে কথা বলে। মার্কেট কমিটির পরিচিত একজনকে সাথে মোবাইলে কল দেয়। তার সাথেও কথা বলে। কিন্তু কোনো ব্যবস্থা হয় না। মার্কেট খোলার ব্যাপারে কোনো ইঙ্গিত পাওয়া যায় না। 
দুইমাস আগের একুশদিন লকডাউন ছিলো। তখন নয়দিন পর মার্কেট খুলে দিছিলো। এখন নাকি খুলবে না। সামনে কুরবানির ঈদ। এই অবস্থায় দোকান বন্ধ থাকলে টাকা আসবে কোথা থেকে?
বাসার দিকে হাঁটতে থাকে মনির। মাথায় রক্ত উঠতে থাকে। ব্যথা শুরু হয় মাথায়। কী করবে? ডাক্তার দেখাবে? তাতেও তো ২-৩ হাজার টাকা খরচ হয়ে যাবে।
বাসায় ফিরে আসে মনির। আল্লা আল্লা করে। বাচ্চাদের সাথে কথা বললে মাথার ব্যথাটা কমে। কিন্তু আবার মাথায় চাপ। বেলুনের চামড়ার মতো টান মাথার চামড়ায়।
বেডরুমে গিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ে সে। রোজা ঈদের আগে থেকে গত দেড়মাস দোকান চাকিয়ে ব্যাংকে যে কিছু টাকা জমা হয়েছে তা দিয়ে কর্মচারীদের ঈদ বোনাস দিতে হবে। বেতন দেওয়া যাবে না। বলতে হবে দোকান বন্ধ থাকলে বেতন দেওয়া যাবে না। অন্তত পনেরোদিনের বেতন কম দিতে পারলে, সে টাকা দিয়ে নিজের সংসারটা কোনোরকম চালানো যাবে।

No comments:

Post a Comment

Thank u very much