Tuesday, December 14, 2021

কবি নূর হেলেনের লেখা কবিতা "বকুল ফুল"




 






"বকুল ফুল"

লেখাঃ নূর হেলেন

মাঝি,

আমার কথা মনে নাই তোমার?

সেই যে মাঘের চান্নিপশর রাইত?

মাথার খোঁপাখান খুইল্যা কইছিলা,

বউরে,

তোরে খোলা চুলে পরীর লাহান দেখায়।

যেন আসমান থাইক্যা অহনি নাইম্যা আইলি।


তয় অহন আমি আর পাট কইরা চুল বান্ধিনা।

চিরুনির দাঁতে ছাত্রা পইড়্যা রইছে।

সুগন্ধি তেল শ্যাষবার কবে মাখছি,

মনে নাই।


তোমার লাহান তো কেউ ডাইক্যা কয় না,

আয়, বকুল, তোর চুলে বিলি কাইট্যা দেই।

লাল ফিতা দিয়া পাঁকায়া দেই মালা বেণি।


পা দুইখান কোলের পরে রাইখ্যা কেউ তো কয়না,

আলতার শিশি শ্যাষ?

কাল হাটের থন ঠিক আইন্যা দিমু।


লোহার ছেকলের কালসিটে দাগ,

আমার আলতার নিশান ধুইয়া দিয়া গ্যাছে।

চিল শকুন আইসা আঁচড় কাঁটছে কোমরে ভাঁজে।


থুতনির সেই ছোট তিল,

যেইখানে ঠোঁট ছোঁয়াইয়া তুমি কইতা,

এইখানে আমার মন রাখছি কইলাম,

তুই সামলায়া রাহিস।


আমি, আমি তারে পারিনাই সামলাইতে।

কালা রক্তের ছোপে ডুইব্বা গ্যাছে তোমার মন।


তোমার বকুল এই উচ্ছিষ্ট শরীরডা লয়া দাঁড়ায়া এহনো।

ঘর নাই, গেরস্থি নাই, পাতে নাই এক নলা ভাত।

পথ চাইয়া থাকতে থাকতে দুই চউক্ষে ছানি পইড়া গেছে।


বয়স মুইছ্যা দিয়া গ্যাছে রূপের বহর!


যুদ্ধ শ্যাষে গবাদি লইয়া,

ঘরছাড়ারাও ঘরে ফিরছে।

নয়া সওদাগরেরা নোঙর ফালাইছে ঘাটে।


খালি আমার অন্তরের আগলখান টানা।

তুমি ছাড়া কাউরে দেইনাই সেই সোনার চাবি।

তুমি তো আর ফিইরা আইলানা মাঝি,

নাও ভীড়াইলানা এই উজানডাঙায়।


কলিজায় লাঙল টাইনা আবাদ করছি এই দ্যাশ,

আঁচল খোয়াইয়া পতাকা জরাইছি গতরে।

ওরা তাই নাম দিছে,

বীরাঙ্গনা!

কওতো কেমুন হইছে নামখান?


তবুও আমার মনের হাউস মেটেনা।

তোমার লাহান কেউ তো ডাকে না কাছে।

কেউ তো কয় না,

আয় বকুল তোর চুল বাইন্ধা দেই।

আয়, বকুল, আলতা দেই রাঙা দুইখান পায়।



Sunday, December 12, 2021

মুক্তি যুদ্ধের রনাঙ্গনের অকুতোভয় নারী নেত্রী রওশন আরা বেগম নীলার সংগ্রামী জীবন ...!!

মুক্তি যুদ্ধের রনাঙ্গনের অকুতোভয় নারী নেত্রী রওশন আরা বেগম  নীলার সংগ্রামী জীবন.......

 ©®✒️✒️ফারহানা হৃদয়িনী







বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে নারীদের প্রচুর অবদান রয়েছে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের নারীরা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। 

"শত শত্রুর প্রতিরোধ রুখতে পারে নি তাদের,করতে পারে নি যাদের চেতনার ক্ষয়।নিঃশ্বাসে বারুদের গন্ধ, বুকে প্রত্যয়।ছিল না যাদের কোন প্রাণ হারাবার ভয়।

তাদের চেতনায় শুধু লাল সবুজের পতাকা উড়েছে, তারা রক্তদিয়ে বাংলাদেশের মানচিত্র গড়েছে। তারা অকুতোভয় মুক্তিযোদ্ধা,তারা আমাদের বিজয়, আমাদের স্বাধীনতা এনেছে।"


তেমনি একজন সংগ্রামী নারী কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার রওশন আরা বেগম নীলা। যিনি এমন একজন নারী যে দেশপ্রেমকে রক্তে প্রবাহিত করে এগিয়ে চলেছেন ১৯৬৮ সাল থেকে স্বাধীকার, স্বাধীনতা,অসহযোগ আন্দোলন, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। আজ পর্যন্ত নারী মুক্তি, নারী কল্যান নারী সংগ্রাম,যৌতুক,বাল্যবিবাহ,ইভটিজিং প্রতিরোধ, ও নারীদের সার্বিক জীবনধারার উন্নয়ণে সংগ্রামী নারী রওশন আরা বেগম নীলা রাজপথের চির জাগ্রুক সৈনিক। 

 কুৃমারখালীর মত মফস্বল শহরে মুক্তিযুদ্ধ কালীন সময়ে আন্দোলন সংগ্রামে নারীরা যে ভূমিকা রেখেছিল তা অনেক জেলার নারীরা রাখেন নি। সেই সব সংগ্রামী নারী আজ অনেকেই হয়তো রাজপথ হতে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছেন। কিন্তু রওশন আরা বেগম  নীলা একনিষ্ঠ ভাবে কাজ  করে চলেছেন। 



তাঁর বাবার চাকরি সূত্রে বগুড়া জেলার শান্তাহারে অবস্থান কালীন সময়ে ১৯৫৪ সালের ৬ অক্টোবর তিনি জন্মগ্রহণ করেন ।  ১৯৬৮ সালের শেষের দিকে রওশন আরা নীলার রাজনীতি জীবনের শুরু। তিনি তখন কুমারখালী বালিকা বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণীর ছাত্রী ছিলেন। সে সময় কুমারখালী ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক রেজাউল করিম হান্নানের অনুপ্রেরণায় তিনি ছাত্র রাজনীতিতে যোগ দেন। ১৯৬৮-৬৯ সালে প্রায় প্রতিটি মিটিং-মিছিলে যোগ দিতেন। তখন বঙ্গবন্ধু ঘোষিত ৬ দফা ও ১১ দফা বাস্তবায়নের দাবিতে কুমারখালীতে আন্দোলন সংগ্রাম চলছিল। প্রতিটি মিছিলে তিনি সামনে থেকে স্লোগান দিতেন। ‘জেলের তালা ভাঙব শেখ মুজিবকে আনব’, আপোস না সংগ্রাম-সংগ্রাম সংগ্রাম’, ‘জ্বালো জ্বালো, আগুন জ্বালো,জয় বাংলা’ প্রভৃতি স্লোগানে প্রতিদিন কুমারখালী শহর মুখরিত হতো।




১৯৭১ সালে সারাদেশে শুরু হয়ে যায় মুক্তিকামী মানুষদের সঙ্গে পাকহানাদার আর রাজাকারদের রক্ষক্ষয়ী যুদ্ধ। সেই সময় তিনি মুক্তি যোদ্ধাদের কাছে গ্রেনেড  হামলা ও মেশিনগান পরিচালনার ট্রেনিঙ গ্রহণ করেন। সেই সময় বোরকা পরে পথে পথে ঘুরে যুদ্ধকালীন সময়ের খবর সংগ্রহ করে, মুক্তি যোদ্ধাদের কাছে চিরকূট ও চিঠি পাঠিয়ে রাজাকার ও পাক হানাদারদের অবস্থান সম্বন্ধে খবর পাঠাতেন। তাই যুদ্ধকালীন সময়ে রওশন আরা বেগম নীলা সব সময় রাজাকারদের হুমকি ধমকিতে থাকতেন। একদিন রাতে রাজাকাররা তাদের বাড়ি ঘিরে ফেলে। এক রাজাকার রাইফেল তাক করে তার বুকে। সেই মুহুর্তে তার বাবা অনেক অনুনয় বিনয় করেন তাকে ছেড়ে দেবার জন্য। এর মধ্যে একজন রাজাকার তাঁর সহপাঠী হওয়ায় তাকে সেদিনের মতো মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচিয়ে দেন। 

 ১৩৭০ বঙ্গাব্দে (১৯৬৯) কুমারখালী জে এন হাই স্কুলে নির্মিত কুমারখালীর প্রথম শহীদ মিনার নির্মাণেরও অন্যতম রূপকারও তিনি।



সমাজিক উন্নয়নে  বিশেষ ভূমিকা রাখার জন্য মহীয়সী এ নারী সরকারীভাবে কুমারখালী উপজেলা ও কুষ্টিয়া জেলার শ্রেষ্ঠ নারী হিসেবে  বেগম রোকেয়া দিবসে "জয়িতা" পদকে ভূষিত হয়েছেন।




মহীয়সী এ নারী এখন নিরন্তর ছুটে চলেছেন সমাজের অসহায় পিছিয়ে পড়া, সুবিধা বঞ্চিত হতদরিদ্র নারীদের কল্যাণে। বাল্যবিয়ে বন্ধ ও নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে সোচ্চার এ নারী দিন নেই রাত নেই আন্দোলন সংগ্রাম করে যাচ্ছেন পাশাপাশি সামাজিক,সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে এবং ইতিহাস-ঐতিহ্য সংস্কৃতি-মুক্তিযুদ্ধের ওপর যারা কাজ করে যাচ্ছেন তাদের নানাভাবে সহযোগিতা, পরামর্শ দান করে যাচ্ছেন। 







Friday, December 10, 2021

কবি ও চিত্রশিল্পী শেখ রবিউল হক (শিল্পী থেকে শিল্পপতি; শিল্পপতি থেকে শিল্পী।) ✒️✒️রেফুল করিম

ছবিওয়ালা রবি (শেখ রবিউল হক)

শিল্পী থেকে শিল্পপতি; শিল্পপতি থেকে শিল্পী।

✒️✒️রেফুল করিম






সব জীবনই বোধহয় কোনো না কোনভাবে সৃজনশীলতার পরীক্ষা দিয়ে চলে। আর জীবন কে উজানের দিকে নিয়ে যাওয়া মানেই তো শিল্পিতভাবে বেঁচে থাকা। বেঁচে থাকাটা কারো কারো কাছে শুধুই জাগতিক হিসেব নয়। অতিসংবেদি মন নিয়ে তারা বোঝে জীবন শুধু এই মাটি - পৃথিবীর সঙ্গে সম্পর্কিত নয় - তা দূর নক্ষত্রের সঙ্গে বোঝা পড়া করে চলে।




 তখন চোখের কাছে দেখা সুন্দর একটা ভিন্ন মাত্রা পায়।বিষয়টি বোধহয় আরেকটু বিশ্লেষিত হওয়া দরকার। দুচোখ মেলে যা দেখা যায় তাকে চিত্রিত করা শিল্প নয়।অতিসংবেদিত শিল্পী মনে যে দূরের ইশারা আছে, তার কোনো সংকেত যুক্ত করতে হয় শিল্পে।দৃশ্য গ্রাহ্য একান্ত বাস্তবের মধ্যে একটা অধরা মায়া আছে। সেই মায়ার খোঁজে নিতে চান শিল্পী শেখ রবিউল হক। তিনি পেশায় শিল্পী নন; কিন্তু শিল্পী হয়ে বাঁচতে চান। নিজের অস্তিত্বে তিনি অনুভব করেন সেই অধরা সুন্দরের টান। তাকে মায়াচ্ছন্ন করে রেখেছে শিল্পের কুহক৷ 





শেখ রবিউল হকের  শিল্পচর্চার সূচনা শৈশবে। দেশি পেন্সিল ও দেশি রং দিয়ে তখন কোন মঞ্চ সজ্জার কাজে দক্ষতা  প্রমাণ করেন৷  তারপর বিষয় চিত্রিত করার সুখ তাকে শিল্পের নতুন নতুন দিগন্ত স্পর্শ করার প্রণোদনা দেয়৷ তাই তিনি জলরঙের  ললিত  ভাবটা বুঝে ছবি আঁকেন এবং তেল রঙের গাঢ় স্বভাবটা উপলব্ধি করে চিত্র রচনায় মনেনিবেশ করেন৷ কখনো বাস্তববাদী রীতি মেনে একাডেমির ব্যাকরণ  অনুসরণ করে ছবি আঁকেন, কখনো বা ছবি ছবি তৈরি হয়েছে দ্বিমাত্রিক নকশাধর্মিতায় জোর দিয়ে৷ 




শেখ রবিউল হক শিল্পী থেকে শিল্পপতি, শিল্পপতি থেকে শিল্পী। তাঁর পেশা আবাসন শিল্প। বানিজ্যের লক্ষী বসত করে। লক্ষীর সঙ্গে স্বরস্বতীর যুগলবাসেই জীবন পূর্ণতা পায়- একথা পৌরাণিক কাল থেকে বহুবার সত্য প্রমাণিত হয়েছে। বৈভবের  কাছে এলে অনেক সময়ই মানবতাবোধ ও শিল্পবোধ জীবন থেকে লুপ্ত হয়ে যায়।শেখ রবিউল হকের সুন্দরের সুষমায় স্নিগ্ধজীবন প্রত্যাশা করেন এবং সে পথেই নিবিড় নিষ্ঠায় কাজ করে যাচ্ছেন। দেশে ও বিদেশে তিনি প্রচুর শিল্পীর সঙ্গে মেলামেশা করে চিত্র রচনায়র গূঢ় অর্থ বুঝাতে চেষ্টা করেছেন। পৃথিবীর অনেক বিখ্যাত ছবি পাঠ করে বুঝতে চেয়েছেন সৃজনশীলতার মর্ম। ছবি আঁকার তীব্র আকাঙ্ক্ষা  এবং এ আকাঙ্ক্ষাকে ফলবতী করার জন্য নিজের মতো করে নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন এই শিল্পী। বানিজ্য সফল শেখ রবিউল হকের জীবন শিল্পের সুফলতা ও সফলতা অন্বেষণ করে চলেছে। 




নিসর্গের গীতময় প্রকাশ আর মানুষের অনাবিল ও স্নিগ্ধ অভিব্যক্তি ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছেন এই স্বশিক্ষিত শিল্পী। অপেশাদার ও নিজস্ব  অনুশীলনে যারা শিল্পী হয়ে ওঠেন তারা বিচিত্র বিষয় আঁকেন। তাছাড়া তাদের ভাষাও হয় বিচিত্র রকমের। যেখানে পেশাদার ও একাডেমি শিক্ষিত  শিল্পী  কতগুলো রীতিমাফিক পর্ব অতিক্রম করে নিজের বিষয় ও শিল্প ভাষায় স্হির হন,  সেখানে স্বশিক্ষিত শিল্পী কখনোই একক কোনো ধারা অনুসরণ করতে চান না। একারণেই হয়তো শেখ রবিউল হকের ছবিতে একই সঙ্গে একাডেমিক রিয়ালিজম, ইস্প্রেশনইজম, অ্যাবাস্ট্র্যাকট ইত্যাদি শিল্প রীতি প্রকাশ দেখা যায়। 




সুন্দরের প্রতি পক্ষপাত মানুষের স্বভাবের অন্তর্লীন বৈশিষ্ট্য। যদিও সংজ্ঞা সুন্দরের ব্যাখ্যা করতে গেলে সুন্দর কে আর সীমিত শর্তে সীমায়িত রাখা যাবেনা। তার অনেক সংজ্ঞা তৈরি হবে এবং ইতিমধ্যে অনেক সংজ্ঞাই তাত্বিকেরা নিরূপণ করেছে। তবুও তো প্রকৃতিতে সুন্দরের ধ্রুবক রয়ে গেছে। ফুল সুন্দর, শিশুমুখ সুন্দর অথবা ব্যাপ্ত করে যদি তবে বলতে হয় নিসর্গ, মানুষ ও প্রাণিকূল ইশ্বরের হিসেবে বা প্রকৃতির নিয়মের সুন্দরের প্রতিনিধি। এরকম ভাবন থেকে শেখ রবিউল হক ফুল এঁকেছেন, মানুষ, নিসর্গ দৃশ্য,নারী এবং ভাইবোনের সম্পর্কে গভীরে যে প্রীতি ও স্নেহ আছে, তা ও চিত্রায়িত করেছেন৷ 



শিল্পের একটা বড় বৈশিষ্ট্য উপরিতল দেখে বিষয়টির গভীরতাকে আবিস্কার করা।চোখের দেখা নয়, মনের অনুভবকে দৃশ্যায়িত করার মধ্য দিয়ে চিত্রকলা মাধ্যম প্রকাশের নতুন পথ খুঁজে পেয়েছে। ' অক্সিজেন কারখানা ', ' তিনি একজন ',' নিটোল বন্ধুত্ব' এসব নামের ছবিতে শেখ রবিউল হক বিষয় ছাপিয়ে রং ও গড়নকে স্বাধীনভাবে বিচরণ করিয়েছেন। এ ধরনের ছবিতে ফিগার থাকলেও তা রঙিন নিসর্গের চেয়ে বড় অবয়বে উপস্থাপিত হয়নি। রঙের বিমূর্ত এক চলাচল আছে। শেষে রং নিজের কথা বলবে। চিত্রকলা গভীরতর অর্থে রঙের সংলাপ বিনিময়, অনেক রঙের কাকলি,আলো- অন্ধকারের বুনট মাত্র। এই সত্য যে শেখ রবিউল হকের মর্ম ছুঁয়েছে, তা তার চিত্রকলার দিকে তাকালেই বোঝা যায়।