ছোট গল্প: "প্রকৃত মানুষ"
লেখক: কনক চৌধুরী
রেল স্টেশনের প্লাটফর্মের অদুরে কাঠ গোলাপ গাছের নিচে কালাম মিয়ার চায়ের দোকান। কাঠগোলাপ গাছটা অনেক পুরনো। কালাম বুদ্ধি হওয়ার পর থেকেই দেখছে এই গাছটা। অনেকের অনেক রকম স্মৃতি অাছে এই গাছকে কেন্দ্র করে। কালামও তেমন এক স্মৃতিকে অবলম্বন করে গড়ে তুলেছে এখানে এই চায়ের দোকান।কালাম মিয়ার দীর্ঘ ২৫/৩০ বছরের ব্যবসা। এখন অবশ্য দোকানদারী করা লাগেনা। অবস্থা বেশ ভালো। তা-ও ব্যবসা ছাড়ে না। লোকে এ বিষয়ে জানতে চাইলে সে তেমন কোন সদুত্তর দিতে পারেনা।সে কেবলই । বলে, ইচ্ছে হয় তাই করি। মানুষের কৌতুহল, তাহতে কমে না। সুযোগ কালাম মিয়াকে খোঁচা দিয়ে বলে, কালাম, তোমার মেয়ের বিয়ে দিবা না। মেয়ের এত নাম ডাক। এত ভাল শিল্পী। অার তুমি চায়ের দোকান দি বসে রইছো! কালাম এসবের তোয়াক্কা করেনা। বলে, ওসব নিয়ে ভাবি নে। যেহানে লিখা রইছে সেহানে ঠিকই হইবো। ঘটনাটা যেন কেমন। কালাম মিয়ার মেয়ে যেমন গুণবতী, অাবার ঠিক তেমনই রূপবতী। শিল্পী হিসেবে তার কতো সুনাম। দেশ -বিদেশে কতো প্রোগাম। কতো টাকা।
অার এমন একজন গুণী শিল্পীর বাবা যদি চা ঘুঁটে, তাহলে কেমন লাগে। তাই অনেকেই ঠাট্টা করে বলে, কালাম, শিল্পী বেটি তোমার নিজের মেয়ে তো? কালাম ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। চোখ-মুখ লাল হয়ে যায়। বলে, এমন কথা কচ্চ কে? সবাই বলে, তোমার মেয়ের দিকটা দেখবা না। মেয়ের এতো নাম, অার তুমি.....,। কালাম সব বোঝে। তাই স্বর নরম করে বলে, কর্ম করে খাই, চুরি তো অার করি নে। মানুষ তাও ছাড়েনা। বলে, মেয়ের কথা ভাবলে তোমার ঐ হিসাব ঠিক না। কালাম অস্বস্তিতে ভোগে। বোঝা যায় সে অপমানবোধ করছে। অার সকলের প্রশ্ন এই এক যাইগাতেই।এতই যদি অপমান বোধ,তাহলে চায়ের দোকান কেন? অবশ্য এটাও ঠিক কালাম মিয়া সস্পর্কে অনেকেই অনেক কিছু জানেনা। কারণ সে স্থানীয় লোক না। কাজের সূত্রে একপর্যায়ে এলাকার বাসিন্দা। মানুষের ধারণা কালাম মিয়ার ব্যক্তি জীবনে কোন রহস্য অাছে।
অনেক রাত পর্যন্ত জমজমাট থাকলেও অাজ কালাম মিয়ার চায়ের দোকানে ভীড় অনেক কম। মেঘলা অাবহাওয়ার কারণে অনকে সকাল সকাল চলে গেছে। নাহলে প্রতিদিনের মতো একইভাবে জমজমাট অাসর থাকতো। চায়ের কাপে উঠতো রাজনীতির ঝড়। কালাম মিয়া খুব সজাগ। মানুষের মতি-গতি বুঝে কথা বলে। সব খরিদ্দার তার কাছে সমান। মনে মনে একটা দল পছন্দ করলেও মুখে প্রকাশ করে না। সহজভাবে বলে, ওসব দল-মত বুঝি নে। অাদা 'র ব্যাপারী, জাহাজের খবর রাইখ্যা কাম নি। তারপরও রাজনীতির তর্ক-বিতর্ক নিয়ে কালাম মিয়ার খারাপ লাগে না।বেশ মজা লাগে। এই না হলে চায়ের দোকান। খরিদ্দার লক্ষী। খরিদ্দার-ই হলো দোকানের প্রাণ। তবে খরিদ্দার না থাকলে কালাম মিয়ার মনটা একেবারেই দমে যায়। কিন্তু সেটা যে কেবল ব্যবসার কারণে, এমন না। অন্য কারণ অাছে। যতোক্ষণ লোক সমাগম,হৈ হুল্লোড় অাছে ,ততোক্ষণ কালাম মিয়া ভালো । ফাঁকা থাকলেই কালাম মিয়ার মন খারাপ। রাজ্যের চিন্তা এসে ভর করে। কী এত চিন্তা ? কালাম মিয়া কাউকে কিছু বলে না। কেবল বসে বসে মন খারাপ করে। অাজ ক'দিন ধরেই কালাম মিয়া খুব অস্থিরতায় ভুগছে। মেয়েটি এবার সত্যিই দোকান ছেড়ে দিতে বেশ চাপ দিচ্ছে।অনেকদিন বুঝিয়ে -সুঝিয়ে রেখেছে। কিন্তু অার হচ্ছেনা। দোকান রাখার তো একটা যুক্তিসঙ্গত কারণ থাকবে? সে সদুত্তর তো কালাম মিয়ার কাছে নেই। অার যদি থাকেও, কালাম মিয়াা তো তা প্রকাশ করছে না। অথবা পারছেনা। এর পিছনে হইতো তার কোন ব্যক্তিগত কারণ অাছে। কোন স্পর্শকাতর ঘটনা অাছে। যা তাকে বাধা দিচ্ছে। সেকারণে নিজের বোধটা নিজের মধ্যেই অাঁটকে রেখেছে। তবে কালাম মিয়া এবার অনেকটায় হতাশ। বলা যায় ধৈর্য্যহারা। দীর্ঘ সময় যে সত্যটা বুকের মধ্যে গোপন রেখেছে তা প্রকাশ করতে না পারার বেদনা যে কতো ভয়ঙ্কর তা সে প্রতি মুহুর্তে বুঝতে পারছে।রাত বেড়েছে। খদ্দের পাতি সবাই বিদায় নিয়েছে। কালাম মিয়ারও অার বসে থাকতে ইচ্ছে করছে না।
অন্যদিন অারও কিছুক্ষণ সে বসে। দক্ষিণগামী শেষ ট্রেনটা চলে গেলে তারপর ওঠে। এই শেষ ট্রেনের সাথেই যে রযেছে তার নাড়ী ছেড়া সম্পর্ক। শেষ ট্রেনের হুইসেলের কম্পনের মধ্যেই যে সে খুঁজে পাই ব্যথাতুর জীবনের করুণ সুর। দোকান ছেড়ে উঠার অাগে কালাম মিয়া মনে করে এবার সত্যিই সে দোকনদারী টা ছেড়ে দেবে। জীবনের বহু পথ পাড়ি দেয়া তো হলো। হলো নাতো কিছুই। মনের অাশা শুণ্যই রয়ে গেলো। দোকান বন্ধ করার সব প্রস্তুতি শেষ। কালাম মিয়া এবার দোকানের ঝাঁপ নামাবে। হঠাৎ -ই দোকানের অদুরে দাঁড়ায় এক বড় গাড়ী। ভিতরে এক ভদ্রমহিলা।
ভদ্র মহিলা এদিক ওদিক তাকান।তারপর কালামের দিকে। কালাম মিয়া কিছুই বুঝে উঠতে পারেনা। কিছু জিজ্ঞেস করবে সে সাহসও হয় না। অত বড় বিশাল গাড়ী। অাবার গাড়ীর মধ্যে নামী দামী একজন। ভদ্র মহিলার বেশ বয়স অাছে। চুলে পাক ধরেছে। তবে তা কপালের সামনের দিকে। সামান্য একগোছা লম্বা হয়ে পিছনের দিকে চলে গেছে। সিনেমায় অভিজাত বয়স্ক মহিলাদের যেমন থাকে ঠিক তেমন। মহিলা ঈষারায় কালাম মিয়াকে ডাকেন।কালাম মিয়া সামনে এলে তিনি শেষ ট্রেনের কথা জিজ্ঞেস করেন। ট্রেন অাসার এখনো বেশ কিছুসময় বাকী অাছে শুনে কালাম মিয়ার দোকানে বসতে চান। কালাম মিয়া হতবাক। স্টেশনে ওয়েটিং রুম থাকতে ভাঙ্গাচোরা এই দোকানে মহিলার বসতে চাওয়ার কারণ কী? তার মাথায় কিছুই ডুকেনা। কিন্তু কেউ বসতে চেলে অাবার নাতো বলা য়ায় না। কালাম মিয়া অাগা- মাথা না ভেবে মহিলাকে দোকানে নিয়ে অাসে। মহিলাকে নিয়ে কালাম মিয়া কিছুক্ষণ বেশ ঘোরের মধ্যে ছিলো। অভিজাত এক মহিলা।নামী-দামী মানুষ। কোথায় বসাবে, কীভাবে কথা বলবে। একটা জড়তা তার মধ্যে কাজ করছিলো। কিন্তু না, মহিলা সেরকম না। অনেক সহজ অার সহমর্মি। তবে দ্বিধান্বিত। এক ধরণের ম্রীয়মান ভাব।তাকে দেখে মনে হয় তার অনেক দুঃখ। অার তিনি কিছু বলতে চান। ট্রেনের জন্যে অপেক্ষাটা মুখ্য বিষয় নয়। কালাম বিষয়টা বুঝে উপযাজক হয়ে বলে, অাপনি কী কিছু বলবেন? মহিলা হ্যা অাবার না করে উত্তর দেন,অাসলে অামার একটা বিষয় জানার ছিলো.....। মানে অনেক অাগেকার ঘটনাতো। "অনেক অাগেকার ঘটনা" শব্দটা শুনে কালাম মিয়া চমকে উঠে। ব্যক্তি জীবনের অনেক অাগেকার এক ঘটনা মনে পড়ে যায়। মনের অজান্তেই চলে যায় অতীতে। নিবিড় ভাবে অাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে চিন্তা রাজ্যে। কালামের সে দিনের সব ঘটনা চেখের সামনে ভেসে ওঠে। কালাম তখন প্রায় বেকার। সংসার হয় নাই। রেল স্টেশনে ঘুরে বেড়ায়। মানুষের ব্যাগ- ব্যাগেজ টেনে যা পাই তাই বাবা মার হাতে তুলে দেয়। এই ছিলো তার নিত্য দিনের কাজ। সকাল থেকে রাত অবধি সে বসে থাকতো মানুষের বোঝা টানার কাজে। এ লাইনে কয়টা গাড়ী যায় অাসে সব ছিলো তার মুখস্ত। সে দিনও সে বসে ছিলো শেষ গাড়ীর অপেক্ষায়। শেষ -মেষ যদি কিছু পয়সা মেলে। তখন রাত অনেক। গাড়ীও অনেক লেট। মেঘাচ্ছন্ন অাকাশ। তখন যদিও বৃষ্টি অাসে নাই। তারপরও অনেক ফাঁকা ফাঁকা। বড় প্লাটফর্মের এক কোণায় যেখানে কাঠগোলাপ গাছ,তারই নিচে বসে অাছে এক মহিলা।। সাথে ছোট্ট এক বাচ্চা। কয়েক দিনের হবে। তোয়ালে জড়ানো। চিঁ চিঁ করে অস্ফুট স্বরে কাঁদছে। ফাঁকা যাইগা, মহিলা একা , কালাম অাগ্রহ নিয়ে সেখানে দাঁড়ায়। মহিলা অনুনয়ের স্বরে বলে,ভাই অামার একটা কাজ করে দেবেন? কালাম মুখের দিকে তাকাই, মহিলা ছোট্ট একটা ফ্লাক্স এগিয়ে দিয়ে বলে,
, কোনো যাইগা থেকে এতে একটু গরম পানি এনে দেবেন। হাল্কা গরম। অামার বাচ্চার জন্যে লাগবে। কাজটা এমন কোন কঠিন না। তারপর বাচ্চার জন্য। কালাম চিন্তায় পড়ে। এখন গরম পানি পাবে কোথায়? একমাত্র চায়ের দোকান ছাড়া। তাও তো সবই বন্ধ। একটা খোলা অাছে , তাও অাবার অনেক দুরে। অগত্যা কালাম সেদিকেই পা বাড়ায়। দুঃখের বিষয় অনেক কষ্টে কালাম যখন গরম পানি নিয়ে ফিরে , তখন মহিলাকে অার পাওয়া যায় না। কিন্তু বাচ্চাটা সেখানেই রয়েছে খুব সযত্নে। কালাম মিয়া ভাবে, অাশে -পাশেই হইতো কোন যাইগায় রয়েছে মহিলা।এখনই চলে অাসবে। কিন্তু না। বহু সময় অপেক্ষা করেও মহিলার কোন খোঁজ পাওয়া যায় না। সে অার ফিরে অাসে না। তবে একটা বিষয় কালাম মিয়ার খঁটকা লাগে। সে যখন গরম পানি নিয়ে ফিরে অাসে, তখন শেষ ট্রেন স্টেশনে দাঁড়িয়ে। অাবার অল্প সময়ের মধ্যেই স্টেশন ছেড়ে চলে যায়। এমন হতে পারে, এই সময়ের মধ্যই মহিলা বাচ্চাকে ছেড়ে ট্রেনে উঠে পড়ে, অাবার বাচ্চাকে ছেড়ে চলেও যায়। কিন্তু এর কারণ কী? কোন ভরসায় সে বাচ্চাকে ছেড়ে ট্রেনে উঠে। কোনো মা কী এটা করতে পারে? তাহলে কী খারাপ কিছু? নিশ্চয় কোন জটিলতা অাছে। কালাম ভাবে, যে জটিলতায় থাক। সব জটিলতার উর্দ্ধে হচ্ছে মানবিকতা অার মানবিক দায়িত্ববোধ।
কালামের নিমগ্নতায় ছেদ ঘটে মহিলার ডাকে। মহিলা বলে কী এতো ভাবছেন?কালাম মহিলার দিকে তাকায়। এতোক্ষণ সে ভালোভাবে খেয়াল করে নাই। এবার তার চোখ স্থির হয়ে যায়। ভাবে ভুল দেখছে না তো? অারো নিবিড় ভাবে দেখে। যতো অাগের ঘটনায় হোক, নিশ্চিত হয়, ইনি-ই সেই মহিলা ,যিনি পঁচিশ- ছাব্বিশ বছর অাগে একটা নির্দয় ঘটনার সূত্রপাত করে গেছেন। যার প্রত্যক্ষ স্বাক্ষী কালাম নিজে। কালাম খেয়াল করে মহিলা খুবই ম্রিয়মান। মুখ কাচুমাচু করে অাছেন। হইতো কথা বলতে চান। কিন্তু কীভাবে শুরু করবেন সূত্র পাচ্ছেন না। অাসলে এমন ঘটনা শুরু-ই বা কেমন ভাবে করবেন। খুব অসহায় লাগছে তাকে। কালামের ভিতরে ক্ষোভ থাকলেও মহিলার অসহায়াত্ব দেখে খুব খারাপ লাগে তার। কালাম কী করবে বুঝে উঠতে পারে না। এক পর্যায়ে মহিলা অামতা অামতা করে বলে, এবার বলি, যা বলতে চাচ্ছি? কালাম দীর্ঘ.শ্বাস ছেড়ে বলে, না বলা লাগবে না। কালামের সব কিছুই তো জানা। সে নুতন করে অার কী জানবে ! তবে তার খুব জানতে ইচ্ছে করে, মহিলা এটা কীভাবে পারলেন। একজন মা.....? কালামের মনের কথা মহিলা অাঁচ করে ফেলে। সলজ্জ ভাবে বলেন, অাপনি হইতো ভাবছেন সন্তানটা.... । কিন্তু তা না। অামাদের বিয়ে হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু সামাজিক স্বীকৃতি পাই নাই। বাধ্য হয়েই সেদিন......। কালাম নিবিড়ভাবে কথাগুলো শোনে। কিন্তু অনেক প্রশ্নের জট তার মাথার মধ্যে। তার মধ্য থেকে শুধু একটাকেই সামনে এনে সে ক্ষোভের সাথে জিজ্ঞেস করে, তাহলে এতদিন কোথায় ছিলেন? একবারও অাপনার সন্তানের কথা মনে হয় নাই? হয়েছে। তবে খোঁজ পাই নাই। ঘটনাও তো অাবার লজ্জার.....। এত খোলামেলা কাউকে বলা.....। কালাম সুযোগ বুঝে বলে, তাহলে অাজ যে ......। অামি যে নিশ্চিত হয়েছি । কালাম বলে, কী নিশ্চিত হয়েছেন? অামাকে কী চিনেছেন?। চিনার অাগেই সব কিছু নিশ্চিত হয়ে তারপর এসেছি। কালাম মিয়া বিশাল বিভ্রান্তিতে পরে। অতীত এই ঘটনা সে তো কাউকে কোনদিন বলে নাই। কারোর জানার কথাও না। তাহলে তার সম্পৃক্ততার ব্যাপারে এই মহিলা কীভাবে নিশ্চিত হয়! অনেক কৌতুহল অার সংশয় নিয়ে কালাম জিজ্ঞেস করে কার কাছে, অার কেমনভাবে নিম্চিত হলেন। মহিলা অম্লান বদনে বলেন, মল্লিকার মাধ্যমে। কালাম চমকে ওঠে। মল্রিকা, মানে অামার মেয়ের কাছে? এটা কীভাবে সম্ভব! কালাম বলে, এটা অাপনি কী বলছেন? মল্লিকার এসব জানার তো প্রশ্নই অাসেনা। হ্যা, অাপনি ঠিকই বলেছেন। মল্লিকা এসব জানে -ও না। তাহলে, অাপনি যে বলছেন...........। সে অারেক রহস্য। কালামের বিস্ময়ের শেষ নেই। বলে, কী রহস্য বলেন। মহিলা ধীর শান্ত ভাবে বলেন, অাপনি মনে হয় জানেন না, অামি পেশায় একজন ডাক্তার। ঢাকা থেকে সপ্তাহে একবার অাসি অাপনাদের এখানে চেম্বার করতে। বলা যায় নিজের তাগিদেই অাসি। এখানেই যে অামার.......। অনেক রোগীই অাসে অামার এখানে। মল্লিকা তো সবার পরিচিত। ও অাসে একদিন অামার এখানে।মেয়েটার অনেক সমস্যা। যাকে বলে মেয়েলী সমস্যা। কালাম বিরক্ত হয়। বলে, রোগীর সমস্যা অামাকে বলছেন কেন? মহিলা হাসেন। বলেন, ধৈর্য্য ধরে শুনুন। কালাম মুখের দিকে তাকায়। মহিলা বুঝতে পারে কালামের অবস্থা। বলেন, যা বললে অাপনি বুঝবেন সংক্ষেপে সেটুকু বলি। একটা টেষ্ট অাছে, যার নাম ডি.এন.এ. টেষ্ট। এই টেষ্টে জন্মগত বিষয় বোঝা যায়। অনেক টেষ্টের মধ্যে এটাও মল্লিকাকে করতে দেই। অনেকটা সন্দেহ থেকেই। অার এ থেকেই নিশ্চিত হই ও অামার সেই সন্তান। তবে ওকে কিছু জানাই না। অার মল্লিকাও কিছু জানেনা।কিন্তু ওর কাছ থেকেই জেনে নি অনেক কিছু। সে জন্যেই অাপনাকে বলেছিলাম সব খোঁজ জেনেই অামি এসেছি। কালামের মুখে কোন কথা নেই। সব কিছুই তো সঠিক। মহিলাকে দেখে কালাম সঠিক ভাবেই চিনেছে, এরপর অার কোন কথা নেই। এখন যার জিনিস তাকে ফেরত দিতে হবে। অার এটাই তো ছিলো কালামের একান্ত বাসনা। অার এ জন্যেই তো সে বসে অাছে জীবন- যৌবনের সব কিছু ত্যাগ করে। সে জানতো একদিন কেউ না কেউ অাসবেই এই বাচ্ছার খোঁজ নিতে। খোঁজ নিতে এসে যাতে কেউ ফিরে না যায়,সে জন্যেই দিয়েছে চায়ের স্থায়ী দোকান। মানুষের অনেক বিরুপ কথার পরও দোকান তোলে নাই। এমন কী মেয়ের সম্মানের কথা ভেবেও। বিয়েপর্যন্ত করে নাই, মেয়েকে মানুষ করবে বলে। অাজ সেই কাঙ্খিত দিনটিই তার সামনে। তাহলে তার এমন লাগছে কেন? সন্তান হারানোর নাড়ীছেঁড়া কষ্ট কেন তাকে অাস্টে- পিস্টে জড়িয়ে ধরেছে।কেন বুক ফাটা কান্না তাকে স্থির থাকতে দিচ্ছেনা। মহিলা কালামের অবস্থা বুঝতে পারে। বলে,কালাম ভাই, কী এতো ভাবছেন? কালাম অার ঠিক থাকতে পারে না। কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। কোন রকম নিজেকে সামলে নিয়ে ভাঙ্গা পুরনো এক বাক্স থেকে ছোট পুরনো এক ফ্লাক্স বের করে বলে, অাপা, এই দেখেন সেই ফ্লাক্স, যা দিয়ে অাপনি অামাকে গরম পানি অানতে বলেছিলেন। অাজ এতদিন হলো অামি ফ্লাক্সটা হাত ছাড়া করি নাই। যত্ন করে রেখে দিয়েছি। পঁচিশ- ছাব্বিশ বছর অাগেকার ছোট এই ফ্লাক্সটা যেন জীবন্ত এক দগ্ধ স্মৃতি। স্মৃতির দহনে মহিলার হৃদয়ও কেঁপে ওঠে। তিনিও হাত দিয়ে চোখ মুছেন। প্রকৃতির কী লীলা খেলা! একজন সন্তান ফিরে পাচ্ছেন,অারেকজন সন্তান হারাচ্ছেন। অথচ দুজনের চোখেই অশ্রু। মেঘাচ্ছন্ন অাকাশে পূর্ণীমার অাবছা অালো যেন এক অনন্য খেলায় মেতে ওঠে তখন। মহিলা অাঁচল দিয়ে মুখ ঢেকে উঠে যেতে চেয়ে বলেন, কালাম ভাই ,এবার অাসি তাহলে। কিংকর্তব্যবিমুড় কালাম বিস্ময় নিয়ে বলে, অাপা মেয়ে.....। ..মহিলা ধীর শান্ত অথচ দৃঢ় ভাবে বলেন, কালাম ভাই, অামি তো মেয়ে নিতে অাসি নাই। অামি এসেছিলাম মানবিক গুণসম্পন্ন একজন 'প্রকৃতমানুষ' কে দেখতে।( সমাপ্ত)
No comments:
Post a Comment
Thank u very much