গল্পঃ- "আপনার চেয়ে আপন"
- আর. এ. খাঁন রনি
এইত কিছুদিন আগে মারা গেলাম। কিছুদিন মানে কতদিন জানিনা। জানবইবা কিভাবে? বেঁচে থাকার সময়ে সময়ের হিসাব আর বর্তমানেরটার হিসাব এক না। আমার কিছুদিন হয়তবা ব্যস্ত পৃথিবীর কয়েকঘন্টা। আগে, মানে মৃত্যুর আগে, সেকেন্ডের কাঁটাটা শুধু সামনেই এগুতো। আর এখন সময় আস্তে আস্তে একটু এগোয়, কখনো থেমে যায়। ইচ্ছে হলে পিছিয়েও যায়। মাঝে মাঝে খুব দ্রুত ছোটে, কখনো খুব ধীরে, শামুকের মত, বিরক্তি ধরে যায়। 'শালার সময়।' মনে মনে একটা গালি দিই।
আমি যেদিন মারা গেলাম সেদিন বেশ সুন্দর হাওয়া ছেড়েছিল শহরটায়। ভীষন আপন লাগছিল ইট-কাঠের খাঁচাটাকে। হাতের মুঠোয় রাখা ছোট্ট একটা চড়ুইয়ের মত মায়া মায়া গন্ধ তার। দেখলেই চোখের আরাম হয়। অথচ বেশ কিছুদিন ধরেই আকাশে প্রচন্ড রোদ ছিল। বাইরে বেরুলে গা পুড়ে যায় অবস্থা। জানালা দিয়ে বাইরে বেশিক্ষন তাকিয়ে থাকা যায় না, চোখ করকর করে উঠত। আকাশে আর বাতাসে পিপাসার্ত কাকদের নীরব আহাজারি। সে সময়টুকু ছিল কৃষ্ণচূড়াদের জন্য বড় অসময়। কেউ রোদের ভয়ে চোখ তুলে তাকাচ্ছিল না তাদের দিকে। অবহেলিত কৃষ্ণচূড়ারা উদাস মনে বেঁচে ছিল গাছে গাছে।
অথচ আমি মারা যাওয়ার খানিক পর থেকেই শহরটা মায়ার শহর হয়ে যায়। রোদটা মাখনের মত নরম হয়ে আসে। সূর্যটা পৃথিবীর সাথে তার শত্রুতা ভুলে গিয়ে মুচকি হাসা শুরু করল। খালিচোখে দেখলে মনে হতে পারে আমার মৃত্যুর সাথে সাথে শহরটা অভিশাপমুক্ত হয়েছে। যদিও কথাটা ঠিক না হয়ত। আমার মনে হয় না আমি অভিশপ্ত ছিলাম।
কিভাবে মারা গেলাম তা আমার কাছেও খুব একটা পরিষ্কার না। রাতে সবার সাথে একসাথে বসে রাতের খাওয়া সারলাম, রুমে গিয়ে একটা বইয়ের দু'পৃষ্ঠা ওল্টালাম, একটা গানের তিন লাইন শুনলাম, কিছু ভাল্লাগছিল না। ইদানিং ঘুমরা দেরিতে আসে, ঘুমপাড়ানী মাসী-পিসীর ব্যস্ততা বেড়েছে হয়ত। শেষরাতে ঘুমাতে গেলাম। চোখের পাতায় আবছা ঘুম। সকালে বোধহয় একটু তাড়াতাড়িই ঘুম ভেঙ্গে গিয়েছিল। ঘুম থেকে উঠে দেখি মারা গেছি। এরকম হঠাৎ করে মানুষ মারা যায়! না মরলে বিশ্বাস করতাম না।
মারা যাওয়ার ব্যাপারে আপনার যথেষ্ঠ অভিজ্ঞতা না থাকলে, প্রথমদিকে আপনি ভড়কে যেতে পারেন। আমিও ভড়কে গিয়েছিলাম। এটা অনেকটা হতাশার মত গ্রাস করে নেয়। তবে প্রাথমিক ধাক্কাটা কেটে যাওয়ার পরই আমি মুগ্ধ হলাম। জানালার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা সকালটা দেখে মুগ্ধ হলাম। প্রথমেই মনে হল- সকালটা এত সুন্দর কেন? চারিদিক অদ্ভুত মায়া মায়া। আমার বারান্দা দিয়ে দূরের একটা ... গাছ দেখা যায়। গাছের কচি সবুজ পাতাগুলো সূর্যের আলোতে মিটিমিটি হাসছে। তাদের ফাঁকফোকর দিয়ে সূর্যের কয়েক টুকরো লুটোপুটি খাচ্ছে পায়ের কাছে। বাইরের রাস্তাটা নদীর মত। যেন শান্ত একটা নদী। এখুনি নদীর বুকে টুপটাপ বৃষ্টি নামবে মনে হচ্ছে। কি অদ্ভুত মায়া নিয়ে বসে আছে পৃথিবী। অথচ অন্যান্য দিন হয়ত চোখেই পড়ত না। ঘুম থেকে উঠেই অফিসে দৌড়ানোর তাড়া থাকলে কারইবা চোখে পড়বে? আজকে আমার তাড়া নেই। মৃতমানুষদের তাড়া থাকে না। আমি চোখ ভরে সকাল খেতে থাকলাম।
মা হয়ত ঘুমাচ্ছেন। ফজরের নামাজের পরের গাঢ়, শান্তির ঘুম। তাকে জাগাবো কিনা ভাবলাম। মাকে গিয়ে বলব যে আমি মারা গেছি? তবে চোখ খুলেই এরকম একটা খবর শোনা উচিৎ হবে না বোধহয়। হার্টবিটের গন্ডগোল হয়ে যেতে পারে। তাই তাকে আর জাগাতে গেলাম না। ঘুমাচ্ছে, ঘুমাক। তাছাড়া মৃত্যু কোন খুশির খবর না যে ঢাকঢোল বাজিয়ে বলে বেড়াতে হবে। আর এখন জানলেও জানবে, পরে জানলেও জানবে- একই কথা। এইসব ভাবতে ভাবতে রাস্তায় নেমে এলাম। বাইরে বৃষ্টির মত কুয়াশা পড়ছে। হাতের ছাপওয়ালা পাতলা নীল টিশার্টটা পড়ে আছি বলে হালকা শীত শীতও করছে। যেন শীতের সকাল।
রাস্তায় গাড়ির সংখ্যা কম। দানবগুলো এখনো ঘুমাচ্ছে হয়ত। পিচঢালা কালো রাস্তায় শিশিরের প্রলেপ দেয়া। বাতাসে জলের গন্ধ ভাসছে। বৃষ্টি নামতে পারে। যদিও আকাশে খুব একটা মেঘের আনাগোনা নেই, নীল রঙের আধিক্য সেখানে। নরম রাস্তার পাশের ফুটপাত দিয়ে হেঁটে চলি সামনে। ফুটপাতের বাম পাশের লাগোয়া গাছগুলোর শাখা বাতাসের প্রশ্রয়ে দুলতে থাকে, হেসে কুটিকুটি হয়। যেন খুব মজার কোন কথা শুনে মুখে শাড়ির আঁচল দিয়ে হাসছে তরুনীর দল। কুয়াশার কারনে সবুজ পাতাগুলো আরো সজীব, আরো সবুজ হয়ে আছে।
মাঝে মাঝে দু'একটা গাড়ি পাশ দিয়ে হুশহাশ বেরিয়ে যাচ্ছে। তাদের যাত্রীদের নিশ্চয়ই ভীষন তাড়া আছে। দেরি হলেই লোকসান হয়ে যাবে। আমার মাঝে মাঝে ইচ্ছে করছিল, একটা একটা করে গাড়ি থামাই। থামিয়ে তাদের আকাশ দেখাই, সবুজ দেখাই। বাতাসের কথা শুনে গাছ কিভাবে হেসে ওঠে নিজ কানে শুনুক। কচি ঘাসের ডগার উপর ঘাসফড়িং কিভাবে ধ্যান করে দেখুক তারা। কিন্তু পরক্ষনেই এই চিন্তা বাদ করে দিলাম। পাগল বলে পুলিশে দিলে হয়ত মৃতমানুষ হয়েও পার পাবো না। ইদানিং নাকি তাদের মানিব্যাগের স্বাস্থ্য ভালো না। স্যালাইন দিয়ে রাখতে হচ্ছে।
ঢাকার পার্কগুলো ছোট হয়ে আসছে। সাথে সাথে আকাশটুকুও। আকাশ ছোট হলেও শহরের পার্কের পেশাদার বাদামবিক্রেতাদের সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে। একটা পার্কের মর্যাদা নির্ভর করে তার বাদামওয়ালাদের উপর। বাদামওয়ালা হচ্ছে পার্কের শোভা। ফ্রান্সের শোভা যেমন আইফেল টাওয়ার, পার্কের শোভা হচ্ছে বাদামবিক্রেতারা। প্রেমিক-প্রেমিকারা এখন আর বাদাম খেয়ে প্রেম করে না। চাইনিজের নরম লজ্জিত আলোয় তারা প্রেম করে। তাই বাদাম ব্যবসার অবস্থা ভালো না। দেশের বাদামশিল্প আজ হুমকির মুখে। তবে আমার সামনের বাদামবিক্রেতাকে দেখে সেই কথা মনে হয় না। তার পরনে ফুলহাতা শার্ট, প্যান্ট। প্যান্টের হাঁটুর কাছে একটা তালি আছে যদিও। পায়ে জুতা। তার একপাটির মাথা দিয়ে তার বুড়ো আঙ্গুল উঁকি দিচ্ছে। এটা নিয়ে সে যথেষ্ঠ বিব্রত অবস্থায় আছে। একটু পরপর আঙ্গুল জুতার ভেতরে নেয়ার চেষ্টা করছে। তাতে খুব একটা সুবিধা হচ্ছে না। একটু পরপর মাথা বের করে পার্কের আকাশ দেখছে। তার যে মালিক তাকে নিয়ে বিব্রত, তাতে কোন পরোয়া নেই।
'স্যার, বাদাম নিবেন?'
'না'
'নিতে পারেন স্যার। ভালো বাদাম, খাইলে বাড়িঘর ভুলে যাবেন। পার্কেই পড়ে
থাকবেন দিন-রাত। আমারে দেখলেই ডাক দিবেন, মফিজদ্দীন বাদাম দিয়ে যাও।'
লোকটা বেশি কথা বলে। তবে তাতে করে মফিজদ্দীনের নাম জানা গেল। তার জুতার
অবস্থা দেখে মায়া লাগছে। কিছু বাদাম কিনতে পারলে হয়। কিন্তু উপায় নেই।
'আমার কাছে টাকা নেই মফিজদ্দীন'
'পরে দিয়েন তাহলে। পাঁচ টাকার দিই? দিনের প্রথম কাস্টমার'
'পরেও টাকা থাকবে নারে। আমি মারা গেছি। মরা মানুষের টাকা-পয়সা থাকে না।'
শুনে মফিজদ্দীনের চোখ ছোট হয়ে আসে চাইনিজদের মত। কপালে ভাঁজ পড়ে।
'মারা গেছেনতো বাদামের দিকে চাইয়া থাকেন কেন? শুধুশুধু এতগুলান কথা বলাইলেন।'
সে দুপদাপ পা ফেলে অন্য দিকে হেঁটে যায়। বেচারার দিনের প্রথম কাস্টমারই মরা
মানুষ। মফিজদ্দীনের কপালে আজকে খারাপি আছে। মরে যাবার জন্য এইপ্রথম আমার
একটু আফসোস হল। আর কখনো খোসা ছাড়িয়ে কুটুস করে বাদাম খাওয়া হবে না। কখনো
কখনো ভুলে বাদামের খোসাশুদ্ধ মুখে পুরে দেয়া হবে না।
বাসে ভীষন ভীড়। পা রাখারও জায়গা নেই। মোট সংরক্ষিত সিট বারটা- মহিলাদের জন্য নয়টা আর মৃতদের জন্য তিনটা। তিনটা সিটেই মৃত প্যাসেঞ্জাররা বসে ছিল উদাস উদাস চোখ মেলে। তিনজনের মধ্যে একজনকে আমার পুরোপুরি মৃত মনে হল না।
প্রিয় আড্ডা নগরে গেলাম। বরাবরের মতই বশির,আকাশ,মেহদী ভাই'রা বসে আড্ডায় মেতেছে। তবে আজকের আড্ডার ট্রপিকটা মনে হচ্ছে সচরাচরের চেয়ে ভিন্ন। বেশ প্রাফুল্য ফুটে উঠেছে তাদের মিলনায়তনে। আমাকে দেখেই সবাই স্বাভাবিক সুরে জিজ্ঞেস করল 'কিরে মারা গেলি কখন?' গত রাতেই। এমতাবস্থায় ইয়াসিন-মোমরাজও আসলো আড্ডায় যোগ দিতে। আর আমাকে বলল 'কিরে দেখেতো মনে হচ্ছে মারা গেছিস, আবার এখানে আসছিস কেন?' ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে 'কি আর করার?' বিদায়ই নিলাম। চির বিদায়!
কলেজে গেলাম। কুইজ ছিল একটা। ইকোনমিক্সের কুইজ। কিছুই পড়িনি
অবশ্য। জাস্ট দেয়ার জন্যই যাওয়া। আর যদি কারোরটা দেখার সুযোগ মিলে তাহলেতো
পাঙ্খা। ক্লাসের সবার মুখে একই কথা। 'কখন মারা গেলি?','কিভাবে মারা গেলি?'
এক ফ্রেন্ড(উদয়) আফসোস করল। আমি মারা গেছি সেজন্য না। নিজে এখনও বেঁচে আছে
বলে। বেঁচে থাকা মানেই- ক্লাস, ল্যাব,কুইজ ইত্যাদি ইত্যাদি। আমিও চিন্তা
করে দেখলাম কথা মিথ্যা না। মরে গেছি ভেবে নিজেকে কিছুটা হালকাও মনে হল।
ক্লাসে স্যার আসলেন। খাতা দিচ্ছিলেন একজন একজন করে। আমি খাতা নেয়ার জন্য
হাত বাড়ালাম। স্যার বললেন,'তুমি কবে মারা গেছ?'
সঠিক উত্তর জানা নেই। বললাম,'গতকাল রাতে।'
স্যার বললেন তাহলে আমার কুইজ দেয়ার দরকার নাই। বাসায় যেয়ে রেস্ট নিতে। আমি
বেরিয়ে পড়লাম। আসার সময় দেখি আফসোস করা ফ্রেন্ডটার চেহারা কান্না কান্না
হয়ে গেছে। বেচারা হয়ত কেঁদেই ফেলবে। আর জাহাইন্নাতো কথাই বলল না। অথচ ওর
জন্য স্কুল জীবনে কত ঝামেলায় না পড়ছি শুধু ওরে বাঁচানোর জন্য। সব কয়টা
স্বার্থপর।
পরক্ষনেই গেলাম রাবেয়ার সাথে দেখা করতে। ও রেগে ছিল।
'তোমার ফোনে রিং হয়। রিসিভ করো নাই কেন?'
'আমিতো মারা গেছি। রিসিভ করবো কিভাবে?'
'আজিব! মারা গেলে ফোন রিসিভ করা যায় না নাকি?'
আমি চুপ করে গেলাম। কথা বলা মানেই রাবেয়াকে আরো রাগানো। ও চোখ তুলে আমাকে ভালোভাবে দেখল।
'সত্যিই মারা গেছ তুমি? কবে?'
'কাল রাতে'
'তাহলেতো আমাদের ব্রেকআপ হয়ে গেছে। তাই না?'
'হু তাই'
রাবেয়াকে দুঃখী বা বিষ্মিত কিছুই মনে হয় হল না। অথচ মরে যাবার আগে যখন আমার
একটু জ্বর কিংবা হালকা ঠান্ডাও লাগতো তখন রাবেয়ার কি আহামরি অবস্তায় না
হয়ে যেত! আর এখন আমি মারা গেছি- এটা প্রিয়তমার কাছে যেন নিতান্তই স্বাভাবিক
ব্যাপার। এত দিনের রিলেশনের ইতিও কোন আহামরি ব্যাপার না। আমি আবার মারা
যেতে চাইলাম।
যার কাছে আমি বাঁচতে এসেছিলাম সেই যদি গলা চেপে ধরে,আষাঢ়ের শেষ রাতে আমি কার কাছে যাবো?
দাড়িয়ে আছি অবকাশ প্রান্তরে। এ যেন কাপোল-কাপোলিদের চন্দ্রনাথ। জোৎস্নায় প্লাবিত চারিদিক। তিতাস । নদীর জল চিকচিক। মৃদুমন্দ বাতাস। ঢেউয়ের তালে দুলছে উন্মাতাল দুই হৃদয়। অভিসারে বেরিয়েছেন দু’জনায়। প্রথম প্রেম আজ পরিপূর্ণতা পাবে হয়তো…
খোলা ডেকে পাশাপাশি দু’জন। নারীর এলোচুল বাউরি বাতাসে এলোমেলো। ছুঁয়ে ছুঁয়ে যায় পুরুষের চিবুক। ক্ষণিকের ছুঁয়ে যাওয়ায় সে যেন এক দিকভ্রান্ত নাবিক। হারিয়েছে পথের দিশা। তার খোলা বুক। ভিতর থেকে উকি দেয়া কালো পশমে ঢাকা চওড়া বুক, অজান্তেই ঢোক গিলতে বাধ্য করে নারীকে। জ্বলে ওঠে তার চোখ। ভিতর বাহিরে নারী অঙ্গারে পরিণত হয়। পুরুষের দিকে তাকায় একপলক। কোথায়ও কেউ নেই। চারদিকে নিঃসীম নিঃসঙ্গতায় ডুবে আছে চরাচর। একটু একটু ঢেউয়ের তালে দুলতে থাকা নিঃসঙ্গ বোটের দুই বিপরীত লিংগের মানুষ দু’জন ছন্দে ছন্দে একে অপরকে ছুঁয়ে যায়। কোথায় যেন জ্বলে যায়.. তবুও শান্ত.. কি এক ইংগিতের অপেক্ষায় মৌণ দু’জন!
নারীর অপেক্ষা সহ্য হয়না। কিন্তু দু’জনের ভিতরে কঠিন শপথ- কেউ কাউকে ছুঁবে না আগে। যে অগ্রণী ভূমিকা নেবে, তার হার হবে। তাই অসহ্য জ্বলনে কষ্টকর মুহুর্ত পার হচ্ছে নিঝুম নিমগ্নতায়!
পুরুষের শরীরের নিজস্ব ঘ্রাণে উদ্বেলিত নারী! কি এক অমোঘ আকর্ষণে একটু ঝুঁকে পড়ে সে পুরুষের দিকে। তার এক চোখ নিজের অবাধ্য চুলে ঢেকে আছে। অন্যটি পূর্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। অস্ফুট নিরব মিনতি তার কাঁপন ধরানো চোখের তারায়। গোলাপী ঠোঁটের নিজেদের জোর করে চেপে রাখার অপপ্রয়াস হঠাৎ বিচ্ছিন্ন হয় নারীর সুরেলা কণ্ঠের ঝংকারে-
“ধীরে ধীরে তোমার সমস্ত হাসির রং হলুদ
ধীরে ধীরে তোমার সমস্ত গয়নায় শ্যাওলা
ধীরে ধীরে তোমার মখমল বিছানা
ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টিতে, ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টিতে সাদা ।
সেই সাপটা বুঝি তুমি ?
না।
তবে ?
স্মৃতি।
বাসর ঘরে ঢুকার সময় যাকে ফেলে এসেছিলে
পোড়া ধুপের পাশে।”
পুরুষ এতক্ষণ নিজের পৌরুষকে অবদমিত করে রেখেছিলো শপথের কঠিন নিষেধের বেড়াজালে। নিঃসঙ্গ যুবতীর শরীর ছাপিয়ে বাতাসে ভেসে বেড়ানো কামনার বহ্নিশিখারা, এক মায়াবী কোমল নারীর সুরেলা মধুমাখা আবৃত্তি শুনে-নিজেরাই নিজেদের শরীর পেট্রোলে ভিজিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়! জ্বলে ওঠে পুরুষের আপাদমস্তক.. সে বিস্ফারিত নেত্রে কল্পনায় নারীর শরীরের বাঁকে বাঁকে নিজের ভিতরের নিজকে অবগাহনরত দেখে। আপনাতেই তার মুখ দিয়ে বের হয়-
“বরফের কুঁচির মতন
সেই জল মেয়েদের স্তন!
মুখ বুক ভিজে,
ফেনার শেমিজে
শরীর পিছল!”
আরো একটু আসে নারী! নিঃশ্বাস ঘন দূরত্ব দু’জনের.. হৃদয়ের সিস্টোল-ডায়াস্টোল দামামা বাজিয়ে চলেছে.. নাকের পাটা ফুলে ফেপে একাকার.. কিছু একটা আটকে আসতে চায় গলার কাছে নারীর! মনে মনে বলে সে, ‘ধুর ছাই! জাহান্নামে যাক শপথ’.. মুখে বলে-
“তোমাকে দেখার মতো চোখ নাই, তবু,
গভীর বিস্ময়ে আমি টের পাই- তুমি
আজো এই পৃথিবীতে রয়ে গেছো।
নারী নিজেই সমর্পিত হয় পুরুষের বাহুডোরে.. রুপালী চাঁদ জোৎস্না কে বলে ধীরে বহো.. নদীর জলে চিকচিক করে নারীর কালো এলোচুল! পুরুষ নারীর বাঁকে বাঁকে রসুনের খোসার মতো পরতের পর পরত খুলে অবগাহন করে আর বলে, ‘হ্যা! আমি আজো এই পৃথিবীতে রয়ে গেছি কেবলি তোমার জন্য!’
এক নিঃসঙ্গ বোটে- নদীর ঢেউয়ের তালে তালে, চাঁদ আর জোৎস্নাকে সাথে নিয়ে, ছন্দে ছন্দে কাঁপন ধরিয়ে যায় ফেরারি সময়।।
রাত হয়েছে। বাসায় ফিরতে হবে।
রাস্তায় হাঁটছি। আমার মৃত্যতে কারো কোন দুঃখ নেই। দুঃখতো পরের কথা; বিষ্ময়ও নেই। বেঁচে থাকলে মনটা বেশ খারাপ হত। মৃত মানুষের মনই নেই; খারাপ হবে কি। এখন একটা সিগারেট টানতে পারলে মন্দ হত না। বুক ভরে নিতাম নষ্ট নিকোটিনে। একটা টঙের দিকে এগোলাম। সিগারেট কিনব।
দোকানদার সরুচোখে তাকিয়ে আছে। 'আপনে কি মারা গেছেন?'
'হু। কাল রাতে।'
'তাইলে আপনে সিগারেট দিয়া কি করবেন? মারা গেলেতো বিড়ি খাওয়া যায় না।'
'কিছু করব না। ফালাইয়া দিব'
'সিগারেট বেচুম না। মরা মাইনষের কাছে সিগারেট বেচি না।'
বাসার উদ্দেশ্যে রওয়ানা।
ওপরে আকাশের দিকে তাকাচ্ছি আর মনে পড়ে যাচ্ছে স্মৃতিময় সব মূহুর্তগুলো।
"চাঁদ মামা আজ বড্ড একা বড় হয়েছি আমি,
রোজ রাতে আর হয়না কথা,
হয়না নেওয়া হামি।
রোজ রাতে আর চাঁদের বুড়ি কাটেনা চরকা রোজ,
ও বুড়ি তুই আছিস কেমন?
হয়না নেয়া খোঁজ!
কোথায় গেল সেই রূপকথার রাত হাজার গল্প শোনা?
রাজার কুমার,কোটালকুমার,পক্ষীরাজ
সে ঘোড়া!
আলাদিন আর জাদুর জিনে আমায় ডাকছে শোনো...
ব্যস্ত আমি ভীষণ রকম সময় তো নেই কোন।
আলিবাবার দরজা খোলা চল্লিশ চোর এলে
সিন্দাবাদটা একলা বসে আছে সাগর তীরে।
সময়টা আজ কেমন যেন বড় হয়ে গেছি আমি
তারা গুলো আজও মেঘের আড়াল কোথায় গিয়ে নামি?
কেড়ে নিলো কে সে আজব সময়
আমার কাজলা দিদি!"
এই মুহূর্তে ভিষণ আপন মনে হচ্ছে 'ওল্ড স্কুলের' কথা গুলো।
হায় আমার শৈশব!
ফেলে আসা লাল গোলাপ।
আমার এই অন্তিম বিষাদ কালে-
চঁন্দ্রিমা,ইন্দুবালা,চঁন্দ্রপ্
চলার পথে রিফাত ভাইয়ের প্রিয়তমার সাথে দেখা। আমাকে দেখা মাত্রই দৌড়ে এসে কাঁদো কাঁদো গলায় বলে তাদের নাকি অনেক দিন ধরে কোনো যোগাযোগ নেই। 'আপনি কিছু একটা করেন ওরে ছাড়া আমি বাঁচতে চায় না এই পৃথিবীতে। তাইলে মঙ্গলে চলে যাওনা কেন?(মনে মনে বললাম)। এমনিতেই আমার আমি মরে গেছি তার মাঝে উনার আলগা পিরিতি। আমি বিষয়টা খুলে বললাম- আমি মারা গেছি। 'মারা গেছেনতো কি হয়ছে? এই ধরেন এই চিঠিটা শুধু ওর কাছে দিয়ে দিবেন আর কিছু করতে হবেনা আপনাকে' এই বলে চলে গেল। এখন চিঠিটা আমি কি করে পৌছায়? মরে গিয়েও শান্তি নাই এই কাপোত-কাপোতিদের জন্যে। কি আর করার যা আছে কপালে।
বাসার অতি নিকটে এসে অবশেষে দেখা মিলল রকি আর হাবিবের সাথে।
চিরচেনা পুকুর পাড় গল্পে মগ্ন তাহারা। আমাকে দেখা মাত্রই তারা আতকে উঠে আর
বলে 'শুনলাম তুমি নাকি মারা গেছ? মরা মানুষ হইয়া এতো রাতে বাহিরে কি?'
এই কথা শুনে তাদের সাথে কথা বলার ইচ্ছাটাই মরে গেল। ও আমি নিজেইতো মরা।
অতঃপর মনে পড়ে গেল চিরকোটের 'আহারে জীবন!'
এই চরম বাস্তবিক মুহূর্তে মনে পড়ছে একজন মহা কবি'র মহা কাব্য'কে। যার অন্তরে সর্বদাই মানবতার প্রবাহমান স্রোত বিদ্যমান। তার নাম বললে বা লিখলে মনের অজান্তেই ভাই নামক ভালবাসার সূত্রটি চলে আসে। হ্যাঁ তিনি 'জুনায়েদ ইভান ভাই'।
- "আমাদের জীবনে দুটো রেল লাইন আছে। একটা ইমোশন আরেকটি রিয়্যালিটি !
বেশিরভাগ মানুষ যেকোন একটাতে আটকে যায়। হয় খুব বাস্তববাদী হয়; কর্পোরেট ভালোবাসায় নিয়ম করে ঘড়ি ধরে চুমো খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে ! আর নাহয় চোখের দিকে তাকানোই যায় না- আবেগে থরথর করে কাঁপতে থাকে।
যে কবিতা পড়ার পর প্রবল আবেগে আপনার মরে যেতে ইচ্ছে করে, কর্পোরেট লাইফের এই দুনিয়াটাকে অনর্থক নিরর্থক মনে হয় সেই কবিতারও একটা মজবুত রিয়্যালিটি আছে। কবি কিন্তু তার পংক্তিমালা ব্যাগে করে নিয়ে প্রকাশকের সাথে আলাপ করেছেন। যে পংক্তিমালা পাঠ করে আপনি ফ্লোরে চিত হয়ে পড়েছিলেন, সেই পংক্তিমালার আবেগের দামে টেবিলের উপরে রাখা ক্যালকুলেটর দিয়ে কবি তার প্রাপ্য কমিশনের হিসেব কষেছেন ! বেঁচে থাকার জন্য দুটোরই দরকার আছে। তানাহলে ওরা আপনাকে বাঁচতে দেবে না।
খুব সামাজিক কিংবা খুব অসামাজিক কোনটাই আসলে ভালো না। কারো চিন্তা চেতনা আমার সাথে মেলে না তাই আমার চিন্তার অংশে আমি কাউকে রাখব না - এসব অনেক মান্ধাতা আমলের ফিলোসফি। কিছু সয়ে যেতে হয়, কিছু আপনাতেই সয়ে যায়। সব কিছু নিয়েই জীবন।
অফিস পাড়ায় রোদে দর কষাকষি আর শ্রাবণের বৃষ্টিতে কাউকে লং রোডে নিয়ে সব বিলিয়ে দেয়া - দুটোই জীবনের সুন্দর অংশ। বৃষ্টির রাতে লং রোডে ঘুরতে বের হবার পয়সাটা অফিস পাড়ায় রোদে দর কষাকষি থেকেই আসে। দুটোই সুন্দর। দুটোকে আলাদা করে দেখতে গেলেই যত দ্বন্দ্ব।
কোনদিনও নিজের ইমোশনের কাছে হেরে যাবেন না। যখন এই
পৃথিবীটাকে একটা স্বার্থপর গ্রহ মনে হবে; সব কিছু ছেড়ে ছুড়ে হেরে যেতে
ইচ্ছে করবে তখন পা ফেলতে হবে রিয়্যালিটিতে।"
হ্যাঁ আমি এখন দ্বিতীয়টিতে দন্ডায়মান।
সারাদিন বেশ ভাব ধরে ছিলাম। ভাব ধরে ছিলাম- মরে গেছি তাতে কি।
কিন্তু তাদের ব্যাপারটায় নতুনকরে উপলব্ধি হল- আমি মারা গেছি। আসলেই মারা
গেছি। ভরা পূর্নিমার ফিনকি দিয়ে পড়া জ্যোৎস্না আমি দেখব; কিন্তু
জ্যোৎস্নারা আমাকে ছুঁবে না। অকৃতজ্ঞের মতো আমাকে উপেক্ষা করে মাটিতে পড়বে।
তারা ভুলে যাবে তাদের জন্য লেখা আমার কবিতার ঋণ। কেউই আমার আপন হইলনা।
শুধু আপন হলো অসম্ভব ভয়ংকর লাশকাটা ঘর। আমার আপন নীড়।।
সমুদ্রে জাহাজ নেই, অতলে ডুবে গেছে ক্যাপ্টেন। এম্বুলেন্স অসুস্থ; লাশের কপালে দুঃখ আছে।
মৃতরা কাঁদে না; কাঁদতে পারে না। চোখ দিয়ে অশ্রু না গড়ালেও যে কেউ দেখলে বুঝত আমি কাঁদছি। একজন মৃত মানুষ কাঁদছে।
প্রয়োজনে:- 01611501136
No comments:
Post a Comment
Thank u very much