উনিশশো’ একাত্তর
দীপু মাহমুদ
১৯৭১ সাল। নভেম্বর মাসের শুরু। ভয়ংকর ঘুটঘুটে রাত। হাসান আর সঞ্জু ফিরে যাচ্ছে কাঞ্চনঝি গ্রামে। তারা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ক্যাম্প আক্রমণের পরিকল্পনা করেছে। আজ রেকি করতে গিয়েছিল। তোজাম্মেল হোসেন কলেজে পড়ান। যুদ্ধে যেতে পারেননি সেই দুঃখ তার আছে। তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের তাঁর বাড়ি ব্যবহার করতে দিতে চেয়েছেন। হাসান আর সঞ্জু খুশি মনে তোজাম্মেল হোসেনের বাড়ি থেকে রওনা হয়েছে। আসার সময় তোজাম্মেল হোসেন তাদের খেয়ে আসতে বলেছিলেন। তারা খেয়ে আসেনি। এখন ক্ষুধা পেয়েছে। পেটে মোচড় দেওয়া ক্ষুধা। তারা হাঁটছে লম্বা খালের পাড় দিয়ে। ক্যাম্পে ফিরে যাবে। ক্যাম্প প্রায় ৭ মাইল দূরে। যেতে সময় লাগবে। আশপাশে খাওয়ার মতো কিছু আছে বলে মনে হচ্ছে না।
হাসান বলল, পাশের জমিতে দেখ টমেটো বা মূলা কিছু আছে কিনা। তুলে কাঁচা খাওয়া যাবে।
আশপাশের জমিতে সেরকম কিছু পাওয়া গেল না। ধান উঠানোর পর খাঁ খাঁ করছে জমি। আকাশ ঘন মেঘে ছেয়ে গেছে। যেকোনো সময় বৃষ্টি হতে পারে। অসময়ের বৃষ্টি। শীত পড়ে গেছে। এখন বৃষ্টি হওয়ার কথা না। এ বছর শীতে বৃষ্টি হচ্ছে। তাতে মুক্তিযোদ্ধাদের অপারেশনে সুবিধা হয়েছে। পাকিস্তানি সৈন্যরা মরুভূমির দেশের লোক। তারা বৃষ্টি ভয় পায়।
বৃষ্টি শুরু হয়েছে। মুষলধারে বৃষ্টি। সেইসঙ্গে দমকা বাতাস। বৃষ্টির ফোঁটা গায়ে সূঁচের মতো বিঁধছে। ঠান্ডার জমে যাচ্ছে ওরা। উঁচু গাছগুলো প্রবল বাতাসে নুইয়ে পড়েছে।
হাসান বলল, এর ভেতর হাঁটব কেমন করে?
আশপাশে কোনো ইশকুল নাহয় মাদ্রাসা পাওয়া গেলে হতো।
আশপাশে কিছু নেই।
কড়কড় আওয়াজ করে বাজ পড়ল। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। সঞ্জু বলল, ওই দেখ সামনে মনে হচ্ছে বাড়ি।
ওরা দুজনে দৌড়ে বাড়ির ভেতর ঢুকে গেল। যেমন হুট করে ঝড়বৃষ্টি শুরু হয়েছিল তেমনি হুট করেই বন্ধ হয়ে গেল। এখন ঠান্ডা বাতাস বইছে।
হাসান আর সঞ্জু বাড়ির উঠোনে দাঁড়িয়ে আছে। ঘরের ভেতর থেকে ছুটে আসার দুপদাপ শব্দ হলো। কেউ একজন উচ্ছ্বসিত গলায় বলল, মা, দেখো এসেছে!
কিশোরী কণ্ঠ। চমকে উঠেছে হাসান আর সঞ্জু। এ বাড়ি তাদের অচেনা। চারপাশে ঘোর অন্ধকার। কিছু দেখা যাচ্ছে না। একজন কিশোরী বলছে, মা, দেখো এসেছে। এর মানে কী!
যে দৌড়ে এসেছিল সে শান্তচোখে জানালা দিয়ে তাকিয়ে আছে। মাঝবয়সী এক নারী ঘরের দরজা খুলে বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছেন। তার হাতে কূপিবাতি জ্বলছে। চোখে বিস্ময়। তিনি দরজার কপাট ধরে তাকিয়ে আছেন হাসানদের দিকে। হাসান বোঝার চেষ্টা করছে ঘটনা কী ঘটছে। সে এখনো ঘটনা বুঝে উঠতে পারেনি।
মাঝবয়সী সেই নারী বললেন, ঘরে উঠে এসো।
হাসান আর সঞ্জু ঘরে উঠে পড়ল। তিনি আগলে রাখা দরজার কপাট ছেড়ে দাঁড়ালেন। নরম গলায় বললেন, ভেতরে এসো বাবা।
ঘরের মেঝেতে মাদুর পাতা। তার ওপর খাবার সাজানো। হাসানকে বিভ্রান্ত দেখাচ্ছে। তার সবকিছু এলোমেলো লাগছে। তাদেরকে গামছা দেওয়া হয়েছে। সঞ্জু গামছা দিয়ে মাথা মুছে ফেলল। সে ভিজে জবজবা হয়ে গেছে।
ঘরের মাঝখানে বেড়া। ওপাশে আরেকটা ঘর। ওখান থেকে সেই কিশোরীর গলা শোনা গেল আবার, না মা, সে না!
ভেঙে পড়া হতাশ গলা। কথাগুলো দীর্ঘশ^াসের মতো হাহাকার শোনালো।
হাসান আর সঞ্জু কিছু বুঝতে পারেনি। তারা গায়ের ভেজা কাপড় খুলে চিপে নিল। অস্ত্র দাঁড় করিয়ে রাখল ঘরের বেড়ার সঙ্গে। মাঝবয়সী সেই নারী তাদের খেতে দিলেন।
সঞ্জু বলল, আপনি আমাদের সঙ্গে খেয়ে নিন।
হাসান চুপ করে আছে। তারা কারও বাড়িতে খেতে গেলে বাড়ির কর্তাব্যক্তিকে নিয়ে খেতে বসে। দুটো কারণে তারা এই কাজটা করে। প্রথমত নিশ্চিত হতে চায় খাবারে বিষ মেশানো হয়নি। এখন চারপাশে শত্রু। শত্রুর অভাব নেই।
আর একটা কারণ হচ্ছে অনেক সময় বাড়ির মানুষরা না খেয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের খেতে দেন। সেইজন্য মুক্তিযোদ্ধারা একসঙ্গে খেতে চান। তারা চান না তাদের খাইয়ে বাড়ির মানুষ অভুক্ত থাকুক।
তিনি বললেন, তোমরা খাও। আমরা সন্ধ্যারাতে খেয়ে নিয়েছি।
তাহলে এই খাবার কি আপনার স্বামীর জন্য?
তিনি মারা গেছেন বহু বছর হলো।
তাহলে ছেলে?
মাঝবয়সী সেই নারী চুপ করে আছেন। হাসান খেয়াল করল তিনি কাঁদছেন। শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখ চেপে ধরেছেন। হাসান হকচকিয়ে গেল। সে খাওয়া বন্ধ করে হাত গুটিয়ে বসে থাকল।
তিনি বললেন, আমার ছেলে নেই। একটা মেয়ে। যুদ্ধের কিছুদিন আগে মেয়ের বিয়ে দিয়েছি। জামাই দেখতে বড্ড সুন্দর। রাজপুত্রের মতো। টকটকে ফরসা। সেই আমার ছেলে। সে যুদ্ধে গেছে। পালিয়ে যায়নি। আমাদের বলে গেছে। আমরা তাকে যুদ্ধে যেতে নিষেধ করিনি। যাওয়ার সময় বলল, মা চিন্তা করবেন না। যুদ্ধ শেষ হলেই চলে আসব। আমি চিন্তা করি না। যুদ্ধ কবে শেষ হবে সেই আশায় বসে আছি। মেয়ে আমার প্রতিরাতে ভাত বেড়ে বসে থাকে। যদি ও আসে। যদি এসে ক্ষুধার্ত অবস্থায় খাবার না পায়। তাই জেগে থাকি। উঠোনে শব্দ হলেই মেয়ে আনন্দে লাফিয়ে ওঠে। মনে করে সে এসেছে।
হাসানের আর খেতে ইচ্ছে করছে না। তার বুক ভার হয়ে এসেছে। সে মাথা নীচু করে দরজার দিকে তাকিয়ে আছে।
দরজার কপাট ধরে স্থির দাঁড়িয়ে আছে এক কিশোরী। সে কাঁদছে। তার চোখের পানিতে শাড়ির আঁচল ভিজে গেছে।
No comments:
Post a Comment
Thank u very much