দুটি বোবা নর-নারীর মধ্যে বিয়ে হয়ে গেল। ছেলেটি গাঁদা ফুলের মালা মেয়েটির গলায় পরিয়ে দিল। মেয়েটিও সলজ ভঙ্গিতে কাঁপা কাঁপা হাতে ছেলেটির গলায় ঐ একই ফুলের মালা পরিয়ে দিল। এবার মেয়েটির যা দুই চারজন বান্ধবি ছিল তারা খলবলিয়ে হেসে উঠলো ঠিকই কিন্তু বিদ্যুৎ না থাকায় হেরিকেনের টিমটিমে আলোয় সে হাসি চোখ চেয়ে দেখা গেল না। কেবল একটা রোল খানিকক্ষণ গুঞ্জরিত হয়ে নিশ্চুপ হয়ে গেল। যেহেতু কোনো ধনী মানুষের বিয়ের আয়োজন এটা নয় তাই কাঁচা বেলী বা গোলাপের মালার ব্যবস্থা কেন নেই সে প্রশ্ন এখানে অবান্তর। তবে গাঁদা ফুলগুলো টাটকা। আজকেই তোলা। ছেলেটির একমাত্র বন্ধু বাদল এক ফুল বিক্রেতার বাড়ি গিয়ে কিনে এনেছে। বিয়েতে কোনো নিয়ন আলো জ্বলেনি, কোনো কোর্মা-পোলাও রান্না হয়নি। কার গাড়িতে চেপে ধুলা উড়িয়ে নানান বাদ্য-বাজনা বাজিয়ে লটবহর সমেত বরযাত্রা আসেনি। লোক জন যা এসেছে তা হাতের কড়ে আঙুলে গোনা যায়। কনের বাসা একরুম বিশিষ্ট। বাসার সামনে এক চিলতে দাঁড়ানোর জায়গা। সে জায়গাটুকু আবার বাড়িওয়ালার। অপরিসর রুমটির মাঝখানের চৌকিতে বসানো হয়েছে বর ও কনেকে। তাদেরকে ঘিরে অপ্রসস্ত জায়গা জুড়ে বিয়ে বাড়ির চেনা-অচেনা লোক জন। বিদ্যুৎহীন চৈত্রের গুমোট সন্ধ্যায় মানুষের ঘেমো শরীরের একটা কূট গন্ধ হেরিকেনের অবছা অন্ধকারে ধোঁয়ার মতো ছড়িয়ে পড়েছে। থেকে থেকে জন্তু-জানোয়ারের মতো একটা গুতোগুতির শব্দ, অশ্লীল ফিসফাস বাক্যালাপ ও অট্টহাসির শব্দ শোনা যাচ্ছে। নিতান্ত সাদামাটা ঘরোয়া এ আয়োজনে ছেলেটি ভেবেছিল মানুষের ভিড়-ভাট্টা, হৈ-চৈ তেমন হবে না। কথা বলতে না পারা দুটি মানুষের বিয়ে - এতে অন্য মানুষেরা কী আর আগ্রহ দেখাবে ? কিন্তু অপরিসর রুমটিতে জামাই-বউ দেখতে আসা নারী পুরুষের উপচে পড়া ভিড় দেখে ছেলেটি ভাবলো চিড়িয়াখানার জন্তু দেখতেও এতো ভিড় হয় না। তারা বোবা বলে উপস্থিত উৎসুক জনতা তাদেরকে সার্কাস দলের নট-নটীদের মতো আপদমস্তক নিরীক্ষণ করে দেখচ্ছে। তাদের চোখে-মুখে কটাক্ষের ভাব। বিয়ের মতো এমন মর্যাদাপূর্ণ কাজ তোমাদের মতো দুটি বোবা মানুষের আবার কেন করার দরকার পড়ল ? এসবে তো আমাদেরই একাট্টা অধিকার। কেউ কেউ মুখ টিপে টিপে বিকৃত হাসি হেসে অন্যের গায়ে ঢলে গড়িয়ে পড়তে পড়তে ফিসফিস করে বলে চললো - ‘আরে বোন ওসব কথা বলো না বোবা বলে কী সখ-আহ্লাদ থাকতে নেই না কী ? রাতে স্বামীর কোলে শুয়ে...’ তারপরের কথাটুকু আর উচ্চারণ যোগ্য নয়।
বিয়ের সব অনুষ্ঠানিকতা শেষ হতে রাত সাড়ে নটা বেজে গেল। তারপর কালোমতো স্থূলদেহী এক মহিলা এসে মৌচাকে টিল মারা মতো করে বাজখাই গলাই বলল - ‘মাগিগোর কোনো কাম-কাইজ নাই না কি ? বোবা দুইডা মাইনষের বিয়া দেখইন লাইগ্যা ঘণ্টর পর ঘণ্টা খাড়াই রইছে। ঔই সব বড়িত যাওনা ক্যান? এহানে কী মধু ঝইর্যা পড়ে ? না রহিম রূপভান যাত্রাপালা চলে ? যাও কইতাছি হারামজাদির দল।’ স্থূলদেহী মহিলার কথায় কাজ হলো। দর্শনার্থীর অধিকাংশ ছিল মহিলা আর উঠতি বয়সী পোলা-মাইয়া। এদের বেশিরভাগ পোশাক শিল্প শ্রমিক। সবাই এক এক করে বিয়েবাড়ি হতে বিদায় নিতে শুরু করলো। মিনিট দশেক হলো বিদুৎ এসেছে। সকলে একে একে বিদায় নিলে স্থূলদেহী মহিলাটির পরিচয় জানা গেল। সে বাড়িওয়ালী। নাম হাজেরা। স্বামী বেঁচে নেই। স্বামী পোশাক কারখানার ইলেকট্রিশিয়ান ছিলেন। বাড়িওয়ালীর আদি নিবাস ঢাকার গাবতলী। যে দুটি নর-নারীর বিয়ে হলো ওরা পোশাক শ্রমিক। ছেলেটি নাম টগর আর মেয়েটি পারুল। সবাই ছোটো করে পারু বলে ডাকে। টগর থাকে চট্টগ্রাম বদ্দারহাট। আর পারুর বাসা নাসিরাবাদ। অবশ্য আজ রাত থেকে তার ঠিকানা হবে বদ্দারহাট। আজকে সে এ বাসা ছেড়ে দিচ্ছে। বিয়ের দিন কোনো মেয়ের একেবারে বাসা ছেড়ে দেওয়ার ঘটনা বিরল। পারুলের কোনো বাবা নেই। তার বাবা-মা কেউ বেঁচে নেই। তার কোনো ভাই বোনও নেই। তাদের বাড়ি ছিল ঢাকা সাভারের হেমায়েতপুর বাজার বাসস্ট্যাণ্ডের নিকটে। বাবা ছিল সবজি বিক্রেতা। বাবা-মা মারা যাওয়ার পর বিধবা দাদির সাথে চট্টগামে নাসিরাবাদে একটা বস্তিতে উঠে আজ থেকে দশ বছর আগে। তখন পারুর বয়স ছিল পনেরো বছর। দাদি গুলনাহার একটা পোশাক কারখানায় ডাইং এর কাজ পেয়ে যায়। অজানা অচেনা শহরে একটা চাকরি ও মাথা গোজার ঠাঁই পেয়ে দুটি অসহায় নারী বেঁচে-বর্তে যায়। এখন গুলনাহারের বয়স হয়েছে। তার বয়স ষাট। গুলনাহার এতোদিন নাতনিকে কিছু করতে না দিলেও গত এক বছর পারু গুলনাহারকে আর কারখানায় যেতে দিচ্ছে না। দাদির পরিবর্তে সে নিজেই গুলনাহার যে কারখানায় কাজ করতো সেখানে জয়েন করেছে। গুলনাহার প্রথমে বাধা দিলে পরে পারুর জিদ আর নিজের বয়সের কাছে সে বাধা পরাজিত হয়েছে। কারখানার মালিক ভালো। আর অনেকদিন ধরে কাজ করায় গুলনাহার তার বোবা নাতনির জন্য মালিককে ধরে বসলে মালিক প্রথমে আমতা আমতা করলে গুলনাহার বলেছিল -
‘পারু বোবা হলে কী হবে স্যার ও ভালো সেলাইয়ের কাজ জানে। আপনি ওকে সুইং এ লাগিয়ে দিন। দেখিয়ে-শিখিয়ে দিলে দেখবেন ও ঠিক পারবে। বিশ্বাস করুন।’
সেই থেকে শুরু পারুর চাকরি জীবন। পনেরো বছরের বোবা পারু এখন পঁচিশ বছরের যুবতী। লুপ্ত রাজবড়ি যেমন কথা না বলতে পারলেও অবয়বে ধরে রাখে নানান সৌন্দর্যের কারুচিহ্ন। আগত দর্শনার্থী এসে সে রূপ দেখে বিভোর হয়। ছুঁয়ে দেখার তৃষ্ণাবোধ করে পারুর রূপও সেই রকম। ও বোবা বলেই ওর শরীরে সে রূপ আরো বেশি ভাষায়িত ও রেখায়িত হয়ে উঠেছে। তাই কথা বলতে না পারায় নিজের প্রতি ওর আগ্রহ কম থাকলেও শুধুমাত্র রূপের কারণে ওর প্রতি অন্যের আগ্রহের কমতি নেই। চাকরি পেয়ে পারুর শুরু হয় নতুন এক জীবন সংগ্রাম। এতোদিন দাদি তাকে খাইয়েছে পরিয়েছে। এখন সে দাদির দায়িত্ব গ্রহণ করেছে। চাকরিতে জয়েন করার দুইমাস পরে নাসিরাবাদে তার কারখানা হতে আধা কি:মি: দূরে আর একটা কারখানায় চাকরি করা টগরের সাথে পরিচয় ঘটে পারুর। টগরের বাড়ি গাজীপুরের চন্দ্রা। ছোটবেলা মা মারা যাওয়ার পরে বাবা তাকে ঢাকায় একটা এতিমখানায় দিয়ে যায়। এরপর বাবা মোসাদ্দেক মোল্লা তার আর কোনো খোঁজ-খবর নেয়নি। তার বাবা আর একটি বিয়ে করার কথা সে শুনেছিল আরো বছর খানেক পরে। এরও দশ বছর পরে একদিন তার বাবার মৃত্যু সংবাদ পায় সে। এ দশ বছরে মোসাদ্দেক মোল্লা তাকে একটিবারের জন্য দেখতে আসেনি। প্রকৃতি যাকে বোবা করেছে কথা বলার মানবিক অধিকার থেকে যে বঞ্চিত তার প্রতি পিতৃঋণের দায় থাকে না। সে দাবি নিয়ে টগরও কখনো মোসাদ্দেক মোল্লার কাছে দাঁড়ায়নি। এতিমখানাতেই পরিচয় ও বন্ধুত্ব তৈরি হয় বাদলের সঙ্গে। বন্ধুত্ব হরিহর আত্মায় রূপ নেয়। বাদলও এতিম। টগরের পিতা মরার খবর যেদিন এলো তখন তারা কিশোর। সেদিন রাতে তারা দুজন এতিমখানা থেকে পালিয়ে কমলাপুর রেলস্টেশনে এসে চট্টগ্রাম আসার ট্রেন ধরেছিল। চট্টগ্রাম এসে জীবনের রূঢ় বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হয় দুজনকে। প্রথমে একটা জুতো তৈরির কারখানায় কাজ জুটে যায় ওদের। সেখানে দুবছর কাজ করে একটা বিস্কুট তৈরির কারখানায় তিন বছর কাজ করে সেটাও ছেড়ে দেয় ওরা। এরপর বাজারে একটা পুরনো কাপড় বিক্রির দোকানে কাজ পায় টগর। আর নাসিরাবাদ একটা পোশাক কারখানায় চাকরি পেয়ে যায় বাদল। এর আগ পর্যন্ত দুইবন্ধু একই সাথে চাকরি করেছে। এই প্রথম দুজনের দু জায়গায় চাকরি জীবন শুরু হয়। দুজন দুজায়গায় চাকরি করলেও দুজনা চলাচলের সুবিধা এবং বাসাভাড়া কমের জন্য বদ্দারহাটে তারা একসঙ্গে এক রুমের একটা বাসা নিয়ে নেয়। সেখানে থেকেই দুজন রোজ যাওয়া আসা করে। নাসিরাবাদে পোশাক কারখানায় কাজ নেওয়ার তিনবছর পরে বাদল মালিকের কাছে অনেক অনুনয়-বিনয় করে টগরের জন্য তার কারখানায় একটা কাজের ব্যবস্থা করে ফ্যালে। বছর দুই হলো টগর বাদলদের কারখানায় কাটিং সেকশনে জয়েন করেছে। পুরনো কাপড়ের দোকনে কাজ করতে করতে গত তিন বছরে সে কাপড় কাটার কাজটি মালিকের কাছ থেকে ভালো করে রপ্ত করে নিয়েছে। আজ থেকে দশ বছর আগে কমলাপুর রেল স্টেশন ছেড়ে চট্টগ্রাম এসেছিল টগর। তখন সে কিশোর ছিল এখন সে টগবগে যুবক। স্রষ্টা তাকে ভাষাহীন করেছে বটে, কিন্তু তার চোখ দুটি ভাষাদীপ্ত। ঝাঁকড়া চুলের সুঠাম দেহের অধিকারী শ্যামাঙ্গের অধিকারী টগর কথা বলতে পারে না - অপরিচিতদের কেউ এমনটা শুনলে প্রথমে অবাক হয়। পরে টগরকে তারা আপদমস্তক নিরীক্ষণ করে এবং তাদের মুখে একটা অস্ফুট আফসোসের ধ্বনি ‘আহা’ শোনা যায়। টগরের সাথে পারুর পরিচয়ের একমাস পরেই বাদলের চেষ্টায় পারু আর টগরের বিয়ে হয়ে গেল। এর দুই মাস আগে বাদল নাসিরাবাদে তাদের কারখানার সিকিউরিটি গার্ড দেলোয়ারের মেয়ে বৃষ্টিকে বিয়ে করে এনেছে। বাদল চুপচাপ স্বাভাবের হলেও বৃষ্টি চপলা, মুখরা। এই দুই মাসে সে দুই বন্ধুর মধ্যে কেমন যেন সাপের মতো কামনার বিষাক্ত নেশাকে জাগিয়ে তুলতে তৎপর হয়ে উঠেছে। ঘর করে সে বাদলের কিন্তু চোখ থাকে তার টগরের দিকে যেনো। টগর যা মুখ ফুটে চাইতে পারে না, যা বলতে পারে না; যেখানে টগরের সীমাহীন দ্বিধা আর সঙ্কোচ সেখানে বৃষ্টির অবাধ অপরিসীম নিঃসঙ্কোচ বিচরণ। বাদলের রং কালোর দিকে। তবে তা ছাতার কাপড়ের মতো কালো নয়। হ্যাংলা-পাতলা গড়ন। বন্ধু অন্তপ্রাণ মানুষটির কাছে বউ বৃষ্টির আচরণ ক্রমশ দুর্বোধ্য ও রহস্যময় বলে মনে হতে শুরু করেছে। পেটের ব্যথার কথা বলে আজকের বিয়ের অনুষ্ঠানে সে যায়নি। বালিশে মুখ গুঁজে বিছানায় সারাদিন উপুর হয়ে শুয়ে ছিল। বাদল টগরকে দোষারূপ করতে চায় না। টগর পুরুষ মানুষ। হোক সে বোবা। নারীর সাবলীল উপস্থিতি ও সহজাত নিবেদনের ভাষা বোবা পুরুষও বোঝে। তার শরীরেও উদগ্র কামনার বীজ ফোটে। চোখে নেশার মধুরস সৃষ্টি হয়। তার সব কিছু থাকতেও তার বউ কথা বলতে পারে না এমন একজন বোবা মানুষের প্রতি ঝুকলো কেন এটি তার কাছে বড়ই রহস্য মনে হয়। নারী মনের কত খাঁজ, কত তার গোপন কুঠুরি। সব কী পড়া যায় ? আর পুরুষের কাছে সব কী ধরা দেয় ? তার বউ বৃষ্টিই আগুনের উত্তাপ নিয়ে টগরের সামনে হাজির হয়। টগর সে আঁচ থেকে নিজেকে সামলে নেয়ার চেষ্টা করলেও আগুনের ধর্মই হলো তা অন্যের দিকে ধেয়ে আসা। তাই আগুনের কাছাকাছি থাকলে তার ছোঁয়াচ থেকে বাঁচা কঠিন। যে বন্ধুত্ব ভাঙার নয়, হারাবার নয়, বিপন্ন হবার নয় সে বন্ধুকে সংকটের হাত থেকে রক্ষর জন্য বাদল পারুর মতো একটি মেয়েকে খুঁজছিল এবং সেটি মিলেও গেল।
আগে দশ বছর দুই বন্ধু চট্টগ্রাম এসে যে যেখানেই কাজ করুক না কেন এক রুমেই থেকেছে। দুইমাস হলো বাদল আলাদা একটা রুম নিয়েছে। বউকে নিয়ে সে সেখানেই থাকে। বাদলের রুমের পাশের রুমটাতে টগর থাকে। টগর বিয়ে করছে বলে টগরের রুমের সাথে লাগোয়া আরো একটা রুম টগরের নামে ভাড়া নেওয়া হয়েছে। যেহেতু এখন থেকে টগরের সাথে পারু এবং পারুর দাদি গুলনাহার থাকবে এই তিনজনের জন্য দুটি রুম। এটা বস্তিপাড়া বাসাগুলো টিনের ছাপড়া। দুটি ফ্যামিলির জন্য একটি করে রান্নার ঘর আর একটি করে বাথরুম। আশপাশের অন্য বস্তিগুলোর তুলনায় এই বস্তিপাড়াটির বসবাসের ব্যবস্থা ভালো। পরিবেশটাও অতো নোংরা এবং অস্বাস্থ্যকর নয়। তবে ধনী বা মধ্যবিত্তের মতো অতো স্বাস্থ্যকরও নয়। বস্থির গা ঘেঁসে একটা পাউরুটির কারখানা ও একটি শুটকি প্রক্রিয়াজাতকরণের কারখানা আছে। শুটকির গন্ধে গা গুলিয়ে যায়। শুটকির গন্ধের নিচে পাউরুটির ঘ্রাণ চাপা পড়ে যায়। অসুবিধের মধ্যে এটুকুই যা অসুবিধে। তবে যারা নিয়মিত থাকে তাদের ওসব গা সওয়া হয়ে যায়। আর এখানকার মানুষেরা বেশিরভাগই নানা পেশাজীবী ও শ্রমজীবী মানুষ। সারাদিন তারা বাইরে কাজ করে। ঘুমানো ও জৈবিক চাহিদা পূরণের জন্য রাতে তারা ঘরে ফেরে। তাদের সন্তানেরাও সারাদিন ঘরের খোঁজ করে না। বাইরে বাইরে টো টো করে ঘোরে। কুসঙ্গে মেশে, নেশায় আসক্ত হয়। একটু মাথা তোলা হলে যে যার রুটি-রুজির পথ খুঁজে নেয়। দিন শেষে সন্তানদের কে বাসায় ফিরলো, কে ফিরলো না এ নিয়ে বাবা মারা বেশি শংঙ্কিত বা উদ্বিগ্ন থাকে না। তারা ভেবে নেয় আজ না ফিরলে কাল ফিরবে নয়তো পরশু। কোথাও আছে নেশা ভান খেয়ে বন্ধুদের সাথে পড়ে। মরে না গেলে নিশ্চয় ফিরবে। পড়াশোনার ধার তারা ধারে না। এ বস্তির নারী-পুরুষ তাই দৈহিক তাড়নায় ও প্রবৃত্তির নিবারণে মিলিত হয়, নারীর গর্ভে সন্তানও আসে শরীরবৃত্তীয় নিয়মে এবং সে সন্তানের ছন্নছাড়া হয়ে বেড়ে ওঠার প্রক্রিয়াটিও সহজাত নিয়ম বলেই এখানকার বাসিন্দারা মনে করে। শুটকির কারখানা থাকায় এখানে বাসা ভাড়া কম। কনেকে বরের বাসায় নেয়ার জন্য কোনো টমটম, কার বা মাইক্রোবাসের ব্যবস্থা ছিল না। রিকসায় সম্বল। দুটি রিকসা ভাড়া করে চারজন মানুষ চড়ে বসতেই আকাশে মেঘের ডাক শুনতে পেল সবাই। গুলনাহার ও বাদল একটি রিকসায় চড়েছে। অন্যটিতে টগর পারু। রিকসা চলতে শুরু করেছে। নাসিরাবাদ থেকে বদ্দারহাট রিকসা পথ। বাসেও আসা যায়। নতুন বউকে নিয়ে লোকাল বাসে না উঠে টগর রিকসা নিয়েছে। রিকসায় আধা ঘন্টা থেকে পঁয়তাল্লিশ মিনিট সময় লাগে। রওয়ানা দিতে দিতে সাড়ে দশটা বেজে গেল। টগর হাত ঘড়িটা দেখে নিলো রাত পৌনে এগারোটা বাজে। চারিদিক দিয়ে একটা হাওয়া বইছে। রিকসায় হুড তোলা। রাস্তায় গাড়ির সংখ্যাও কমে এসেছে। রাস্তা সুনশান নীরব। মাঝে মাঝে দু একটা সিটি বাস হর্ন বাজিয়ে রিকসার কোল ঘেঁসে চলে যাচ্ছে। হেলপারের কণ্ঠে এই নাসিরাবাদ, চাঁকদা, চকবাজার, স্টেশনরোড ডাক শোনা যাচ্ছে। বাসগুলো যখন তাদের রিকসা ক্রস করছে টগর খেয়াল করলো পারু টগরের বামহাত শক্ত করে জড়িয়ে ধরছে। হয়তো সে ভয় পেয়ে এমনটা করছে। টগর পারুর মাথার উপর ডান হাতটা রেখে স্মিত হেসে ইশারা করে বুঝালো ভয় পেয়ো না আমি আছি। ঘোমটার আড়াল থেকে আঁধারেও যেন বিদ্যুৎ রেখার মতো টগরের মনের কথা বুঝে খুশিতে পারুর চিবুক নড়ে উঠলো। রিকসার ভেতরে দুজনার শরীর দুজনার সাথে পাশাপাশি ঠেসে লেগে আছে। দুজনার শরীর থেকে বের হচ্ছে গাঁদা ফুলের ঘ্রাণ। টগরের ঘরের চাবি বৃষ্টির কাছে রেখে গিয়েছিল। ফুলের দোকানে দুটি ছেলেকে বলা ছিল তারা এসে বৃষ্টির কাছ থেকে চাবি নিয়ে টগরের ঘর খুলে বাসরঘর সাজিয়ে দিয়ে গেছে। কোনটি রুমটি বাসর ঘর হবে টগর তা ছেলে দুটিকে আগেই দেখিয়ে দিয়েছিল। সন্ধ্যার পর ঘর সাজিয়ে ছেলে দুটি বৃষ্টিকে চাবি দিয়ে চলে গেছে। সাজানো শেষ হলে ছেলে দুটি বৃষ্টিকে ডেকে ঘরটা দেখতে বললে বৃষ্টি প্রথমে রাজি না হলেও ছেলে দুটির অনুনয়-বিনয়ে শেষ-মেশ বিছানা ছেড়ে উঠে গিয়ে সে যখন টগর আর পারুর বাসর ঘরের সামনে দাঁড়িয়েছিল তখন বুকের খুব গভীর থেকে একটা তপ্ত নিঃশ্বাস বের হয়ে এসে তার বুকে তা আছড়ে পড়ে বুকটা যেন পুড়িয়ে খাক করে দিয়েছিল। বাসর ঘর টগর সাজাতে চাইনি। বাদল টাকা দিয়েছে। বাদল সাজিয়ে দিয়েছে টগরের বাসর ঘর। বলেছে বন্ধুর তরফ থেকে এটা বন্ধুর জন্য উপহার। টগর বন্ধুকে বুঝিয়েছিল বোবা মানুষের আবার বাসর কিসের? বাদল শোনেনি টগরের কথা। তার স্বামীর কেনা গোলাপের ভাঁজে ভাঁজে পারুর ভালোবাসার উপাখ্যান রচিত হবে। টগরের ঝঁকড়া চুলে, সুঠাম দেহে বোবা পারুর দেহের বুদবুদ জাগবে, ভাষার জোয়ারে ভাসবে না। আর সেখানে সেতারের মতোন দেহ সৈষ্ঠবে বৃষ্টি চাইলেই ছিপছিপে ডিঙি নৌকা হয়ে টগরের দেহে ভাবে ও ভাষায় কাম ও প্রেমের বান ডেকে আনতে পারতো। সাড়ে এগারোটায় যখন বর-কনে সমেত বাদল বাসায় পৌঁছালো ততক্ষণে বৃষ্টির চোখ নিদ্রাচ্ছন্ন হয়ে এসেছে। দরজায় কড়া নাড়ার শব্দে সে জেগে উঠে বসলো। জেগে থাকতে থাকতে সে ঘুমিয়ে পড়েছিল। চোখ দুটি তার ভীষণ জ্বালা করছে। পাতা দুটিও ফোলা এবং ভারী। বেশ খানিকটা সময় কেঁদেছেও সে। এ কান্নার কোনো ব্যাখ্যা নেই। দরজার কড়া নাড়ার শব্দে চোখ দুটি কচলে নিল সে। কাক ঘুম এসেছিল সে। চোখ জ্বালা করার পাশাপাশি বুকটাও কেন যেন জ্বলতে শুরু করলো তার। আলাদা কোনো শাড়ি সে পরেনি। সাজগোছও সে করেনি। যাওয়ার সময় বাদল তাকে একটু সাজগোছ করতে বলেছিল। কানটা খাড়া করলো সে। আর একবার দরজার কড়া নড়ার শব্দ শুনলো। তারপর টিনের চালে টিপটিপ বৃষ্টির শব্দ শুনতে পেল সে। বুকের স্খলিত কাপড়টা টেনে বিছানা থেকে নেমে দরজার শেকল খুলেই সে টগর ও পারুকে দেখতে পেল। কোনো প্রেমিক দীর্ঘদিন প্রেম করে প্রেমিকাকে না বলে কয়ে অন্য কোনো নারীকে বিয়ে করে সদ্য বিবাহিতা বউকে প্রেমিকার সামনে হাজির করলে প্রেমিকার মুখের ভাবান্তর যেমনটি হয়, বৃষ্টির চেহারাটাও এই মহূর্তে তেমনটি দেখলো। কোনো নারীর বিধবা হওয়ার সংবাদ নিশ্চিত হলেও চেহারাটা এতোটা ম্লান ও ফ্যাকাশে দেখায় না। দুটি বোবা ভাষাহীন মানুষের বাসর রাতে ভাষার আবেদন নিয়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। যে মনোযন্ত্রণা নিয়ে বৃষ্টির আজ সারাদিন কেটেছে। তার খবর কে রেখেছে ? আহত পাখির মতো তার মনের ছটফটানি তো কেউ দেখেনি। যাকে পাবে না জানলেও সান্নিধ্যটুকু পাওয়া যাবে এতদিন এ নিশ্চয়তাটুকু ছিল। আজ সে সান্নিধ্য পাওয়ার সুখটুকুও খোয়া গেল। আজ সে চিরদিনের মতো পারুর হয়ে গেল। টগরের সাথে তার সম্পর্ক দেবর-ভাবির হলেও বিয়ের আগে টগরের পুরুষ হৃদয়কে সে তার নারী মন দিয়ে একাকী অধিকার-অনধিকারের মাধ্যমে অনেকখানি দখল করে রেখেছিল। অলিখিত সে অধিকারের মধ্যে টগরও খানিকটা বাধা পড়েছিল। নারী সঙ্গহীন বোবা পুরুষ বন্ধুর স্ত্রী জেনেও বৃষ্টির সঙ্গ সবসময় এড়িয়ে যেতে পারেনি। পারু আসার আগে সেখানে ছিল বৃষ্টির একক কর্তৃত্ব ও দখলদারিত্ব। আজ সে দখলস্বত্ব কড়াই-গণ্ডায় বুঝে নেবে পারু। বোবা বলে তার এক কানা কড়িও ছাড় দেবে না। বুকের যে জ্বালায় সারাদিন জ্বলছিল বৃষ্টি তাতে ঘি ঢেলে তেজ আরো উসকে দিয়ে সে জ্বালা দ্বিগুণ করে তাকে বধূবরণ করতে হলো না। ঝমঝমিয়ে নামা বৃষ্টি তাকে সে যন্ত্রণা থেকে রক্ষে করলো। কোনো রকমে পরিচয় পর্বটুকু সেরে যে যার মতো দৌড়ে ঘরে উঠে গেল।
দুটি বোবা মানুষের বাসর এর চেয়ে আর কী আড়ম্বরতায় হতে পারে ? বাদলের সৌজন্যে সাধারণ একটা চৌকি গোলাপ ও রজনীগন্ধা দিয়ে সাজানো হয়েছে। পায়ের কাছে জানালাটা বন্ধ রাখা হয়েছে যেন শুটকি কারখানার আঁশটে গন্ধ ভেতরে না ঢুকে পড়ে। তবুও বৃষ্টি ও বাতাসের ঝাপটার সঙ্গে সে গন্ধ গোলাপ ও রজনীগন্ধার সাথে মিশে হলেও দুজনার নাকে এসে খানিকটা ধাক্কা খেল। পারু গন্ধটায় নাক কুচকে টগরের দিকে তাকাতেই টগর বিষয়টি বুঝতে পেরে পারুকে ইশারায় সবটা বুঝিয়ে বলল। গুলনাহার তার ঘরে ঢুকে গেছেন। রাতের খাবার তারা সাথে করে নিয়ে এসেছে। কিন্তু কারো কোনো খাবার ইচ্ছে নেই। গুলনাহার পোশাক বদলে এসে তাদের সাথে দেখা করে বলে গেলেন। তখন রাত প্রায় পৌনে একটা বাজে। তিনি ঘুমোতে যাচ্ছেন। তিনি কিছু খাবেন না। পারু ও টগরকেও ঘুমিয়ে পড়তে বললেন। বললেন বাইরে বষ্টি হচ্ছে ওদের যদি কোনো কিছু দরকার হয় তবে ওরা যেন তাকে ডাক দেন। কথাগুলো গুলনাহার বলে চলে গেলেন। পারু ও টগর চৌকিতে পা ঝুলিয়ে বসে ছিল এতক্ষণ। পারু ঘোমটা সরিয়ে ইশারায় টগরকে উঠে দাঁড়াতে বলল। টগর উঠে দাঁড়ালে পারু টগরের পায়ে হাত দিয়ে সালাম করে দাঁড়ালে টগর ডানহাত দিয়ে পারুর থুতনিটা উঁচু করে ধরতেই দেখলো পরম আবেশে পারুর চোখ দুটি বোজা। ঠোঁট দুটি ঈষৎ কাঁপছে। এই মুহূর্তে বুকটাও কী দুরু দুুরু করছে পারুর ? পারুকে বুকে জড়িয়ে ধরলো টগর। দুটি বোবা মানুষের জীবনে এর চেয়ে আনন্দের ক্ষণ আর কী হতে পাওে ? সারা বিশ্ব না জানুক এই বৃষ্টি ভেজা রাত আর পারুর খোপার গাঁদা আর ঘরের গোলাপ, রজনীগন্ধরা জানুক আজ ওদের বাসর। কিন্তু জীবন তো এমন নিরবিচ্ছিন্ন সুখের আধার নয়। বিয়ের পর আবার যে যার মতো কর্মব্যস্ত হয়ে পড়ল সবাই। কেবল ব্যস্ততা নেই বৃষ্টির। গুলনাহার বয়স্ক মহিলা হলেও সে নিজে বাজার করে। টগর ও পারুর জন্য রান্না-বান্না করে। সাংসারিক কাজকর্ম করে তার দিন কেটে যায়। মাঝে-মধ্যে বৃষ্টিকে ডেকে নিয়ে বৃষ্টির সঙ্গে গল্প-গুজব করে। তবে সে গল্প-গুজবে বৃষ্টির ভেতরে সাড়া থাকে না। তার মন অন্য কোথাও পড়ে থাকে। রাতে তার স্বামী বাদল, টগর আর পারু বেশিরভাগ দিন একসাথে ফেরে। কখনো কখনো আলাদা ফেরে। তবে টগর ও পারু সব সময় একসাথে আসে। যত রাতই হোক টগরকে এক নজর না দেখলে তার ভোলো লাগে না। সে জানে এটা পাপ। কিন্তু এ পাপ থেকে সরে আসার উপায়ও তার জানা নেই। বিয়ের দুই মাস যেতেই বৃষ্টির ব্যাপারটা বোবা হলেও পারু বুঝে ফেলছে। সে বিষয়টি টগরকে ইশারা ইঙ্গিতে বুঝিয়েছে এবং এ বাসা ছেড়ে অন্যত্র চলে যাওয়া বাসনার কথাও টগরকে জানিয়েছে। টগর বাদলের বন্ধুত্বের কথা বলে পারুকে বলেছে আর দুই-এক মাস সবুর করতে। এর মধ্যে বৃষ্টির আচরণ ঠিক না হলে তারা বাসা পরিবর্তন করবে। তবে বৃষ্টি আগের চেয়ে অনেক নির্লিপ্ত হয়ে গেছে। এখন সে টগরের দিকে কেবল হ্যাংলার মতো চেয়ে থাকে। কথা-বার্তা কম বলে। বাদল এ নিয়ে বৃষ্টির সাথে অনেক কথা কাটাকাটি পর্যন্ত করেছে। তবে ইদানিং বৃষ্টির আচরণ দেখে বাদল মনে মনে ভেবেছে বোধহয় বৃষ্টি নিজের ভুল বুঝতে পেরেছে। বৃষ্টি বোধ হয় ঠিক হয়ে গেছে। কিন্তু বাদলের একথা জানা নেই পরকীয়া প্রেমের ঘুণ একবার যারে ধরে তাকে তা কেটে কেটে নিঃস্ব না করা পর্যন্ত ছাড়ে না। তাই বৃষ্টিও ভেতরে ভেতরে নিঃস্ব হতে শুরু করেছে। টগর ও পারুর বিয়ের দুইমাস পরে একদিন টগরের ভীষণ জ্বর এলো। পারু অসুস্থ টগরকে দাদি গুলনাহারের কাছে রেখে কারখানায় গেল ডিউটিতে। বাদলও সকালবেলা বন্ধুর কাপলে হাত দিয়ে দেখে বলল তোর গা ভালোই গরম। তোর আজ কারখানায় গিয়ে কাজ নেই। আমি ম্যানেজারকে তোর জ্বরের কথা জানিয়ে দেব। বৃষ্টি ও দাদি থাকবে তোর দেখাশোনা করবে। ঘরে কোনো বাজার-সদায় না থাকায় গুলনাহার বৃষ্টিকে টগরের কাছে রেখে বেলা বারোটার দিকে বাজারে গেলে বৃষ্টির এতোদিনের টগরকে ঘিরে অবদমিত কামনা যেন জনমানব শূন্য ঘরটায় বাধ-ভেঙে গেল। গুলনাহার চলে যেতেই সে টগরের জ্বরতপ্ত কপালটা আচমকা চম্বুনে চম্বুনে ভরিয়ে দিতে লাগলো। টগর গোঙরানির মতো একটা শব্দ করে বৃষ্টিকে জ্বরতপ্ত দুর্বল দুহাত দিয়ে সরিয়ে দিতে চেষ্টা করলো কিন্তু বৃষ্টি চিনে জোকের মতো সবলে শায়িত টগরকে দুবাহু ডোরে জড়িয়ে ধরে টগরের বুকে মুখ গুঁজে বলতে লাগলো তুমি এতো পাষাণ কেন? আমার কষ্ট তুমি বোঝ না ? আমার জ্বর তো তোমার বিয়ের দিন থেকে। আমার অন্তর পুড়ে খাক হয় তুমি দ্যাখো না। তোমার বন্ধু আমারে মারে-কাটে। তারপরেও তো আমি তোমারে ভালোবাসি। তুমি কথা কও তুমি আমারে ভালোবাসো না। ওই বোবা মাগী তোমারে কিচ্ছু দিতে পারবো না। আমি তোমারে ভাষা দিব। আশা দিব। সাহস দিব। বল দিব। ভালোবাসা দিব। আমি তোমার বোবা মুখে কথা হবো। চলো এখান থেকে আমরা দুজন পালায়ে যায়।
টগর গোঙরানি দিয়েই চলেছে। জ্বরে তার গা পুড়ে যাচ্ছে। সে বৃষ্টির বাহুডোর থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য ছটফট করছে। তার কপলে ঘাম জমেছে। তবুও বৃষ্টি তাকে ছাড়ছে না। হঠাৎ একটা আলাদা গোঙরানির শব্দ শুনে দুজনার চোখ গেল ভেড়ানো দরজার দিকে। দরজা ভেতর থেকে লাগানো ছিল না। ভেড়ানো ছিল মাত্র। দরজা খুলে পারু বিছানায় দুজনকে এমন অবস্থায় দেখে ক্ষিপ্র চিতার মতো বৃষ্টির ওপর ঝাপিয়ে পড়ে বৃষ্টির চুলের মুঠি ধরে ফেললো। চুলাচুলি কাণ্ড যখন শুরু হয়ে গেছে তখন বাজার নিয়ে ঢুকলো গুলনাহার। গুলনাহার বিষয়টা কিছুটা আচ করতে পেরে তখনকার মতো দুজনকে নিরস্ত করলো। টগর অসুস্থ থাকায় পারু ম্যানেজারকে বলে আগে চলে এসে যা দেখেছে তার বর্ণনা ইশারায় দাদিকে বোঝাতে গুলনাহার বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে বললো - ‘ছি বউমা তোমাকে তো আমি ভালো বলে জানতাম। সেই তুমি এমন করতে পারলে। আজ রাতে বাদল আসুক এর একটা বিহিত হওয়া দরকার।’ বৃষ্টি কাঁদতে কাঁদতে ঘরে ফিরে গেল।
রাতে বাদল ফিরলে ঘটনা জেনে সে ভীষণ লজ্জিত হলো। টগরের জ্বর এখনো আছে। বন্ধুর জন্য তার কষ্ট হলো। বৃষ্টির জন্য তার করুণা হলো। বৃষ্টিকে কয়েকটা চড় থাপ্পড় দেওয়ার পর মনে মনে ভাবলো আগামীকাল সকালে সে তার বউকে বাপের বাড়ি দিয়ে আসবে। গুলনাহার সাফ জানিয়ে দিয়েছে টগরের জ্বর ভালো হলে তারা এ বাসা ছেড়ে সামনে মাসে অন্যত্র কোথায় বাসা দেখে উঠে যাবে। তবে বন্ধুত্ব তাদের থাকবে। পাশাপাশি বসবাস করবে না এই যা। রাতে বৃষ্টি কোন কিছু খেল না। বাদলের সাথে কথাও বললো না। শুয়ে পড়লো চুপচাপ। বাদল ভাবলো বউকে গায়ে হাত তোলায় রাগ করেছে তাই কথা বলছে না। রাগ পড়লে কথা বলবে ঠিক। তবে অন্য দিনের মতো মারধোরের পরে আজ বৃষ্টি কান্না-কাটি করেনি। কেবল নিরব চোখে বাদলের দিকে চেয়ে ছিল কিছুক্ষণ। রাতে সে চুপচাপ বাদলের পাশে শুয়ে পড়লো।
সকালবেলা বাদলের চিৎকারে বস্তির সবার ঘুম ভাঙলো। ঘটনা হলো এই বৃষ্টি শাড়ি পেচিয়ে ফ্যানের সিলিংয়ের সঙ্গে গলায় দড়ি দিয়েছে। ঘরের ভেতরে শূন্যে ঝুলছে বৃষ্টির নিথর দেহটি। মৃত মুখে নেই কারো ওপর কোন রাগ, ক্ষোভ, ঘৃণা। বস্তিবাসী কেউ বুঝতে পারলো না কেন এই আত্মহত্যা? কেবল চারজন ব্যক্তি জানলো এই মৃত্যুর কারণ। একটু বেলা হলে পুলিশ এলো। ডেডবডি নামানো হলো। ময়না তদন্তের জন্য লাশ পাঠানো হলো মর্গে। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য বাদলকে পুলিশ হেফাজতে থানায় নেওয়া হলো। টগর ও পারু বোবা জেনেও পুলিশ টগর, পারু ও তাদের দাদি গুলনাহারকে বাসা থেকে কোথাও না যাওয়ার নির্দেশ দিল। প্রয়োজনে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাদেরকে থানায় ডাকা হবে বলে জানানো হলো। পুলিশ প্রাথমিক তদন্তে ধারণা করলো এটা একটা পরকীয়া প্রেম ঘটিত আত্মহত্যা। কিন্তু তারা বুঝতে পারলো না এই প্রেম কী একতরফা শুধু মেয়েটির দিক থেকে ছিল নাকি বোবা ছেলেটিরও কোনো ধরনের মানসিক সাড়া ছিল ?
বিয়ের সব অনুষ্ঠানিকতা শেষ হতে রাত সাড়ে নটা বেজে গেল। তারপর কালোমতো স্থূলদেহী এক মহিলা এসে মৌচাকে টিল মারা মতো করে বাজখাই গলাই বলল - ‘মাগিগোর কোনো কাম-কাইজ নাই না কি ? বোবা দুইডা মাইনষের বিয়া দেখইন লাইগ্যা ঘণ্টর পর ঘণ্টা খাড়াই রইছে। ঔই সব বড়িত যাওনা ক্যান? এহানে কী মধু ঝইর্যা পড়ে ? না রহিম রূপভান যাত্রাপালা চলে ? যাও কইতাছি হারামজাদির দল।’ স্থূলদেহী মহিলার কথায় কাজ হলো। দর্শনার্থীর অধিকাংশ ছিল মহিলা আর উঠতি বয়সী পোলা-মাইয়া। এদের বেশিরভাগ পোশাক শিল্প শ্রমিক। সবাই এক এক করে বিয়েবাড়ি হতে বিদায় নিতে শুরু করলো। মিনিট দশেক হলো বিদুৎ এসেছে। সকলে একে একে বিদায় নিলে স্থূলদেহী মহিলাটির পরিচয় জানা গেল। সে বাড়িওয়ালী। নাম হাজেরা। স্বামী বেঁচে নেই। স্বামী পোশাক কারখানার ইলেকট্রিশিয়ান ছিলেন। বাড়িওয়ালীর আদি নিবাস ঢাকার গাবতলী। যে দুটি নর-নারীর বিয়ে হলো ওরা পোশাক শ্রমিক। ছেলেটি নাম টগর আর মেয়েটি পারুল। সবাই ছোটো করে পারু বলে ডাকে। টগর থাকে চট্টগ্রাম বদ্দারহাট। আর পারুর বাসা নাসিরাবাদ। অবশ্য আজ রাত থেকে তার ঠিকানা হবে বদ্দারহাট। আজকে সে এ বাসা ছেড়ে দিচ্ছে। বিয়ের দিন কোনো মেয়ের একেবারে বাসা ছেড়ে দেওয়ার ঘটনা বিরল। পারুলের কোনো বাবা নেই। তার বাবা-মা কেউ বেঁচে নেই। তার কোনো ভাই বোনও নেই। তাদের বাড়ি ছিল ঢাকা সাভারের হেমায়েতপুর বাজার বাসস্ট্যাণ্ডের নিকটে। বাবা ছিল সবজি বিক্রেতা। বাবা-মা মারা যাওয়ার পর বিধবা দাদির সাথে চট্টগামে নাসিরাবাদে একটা বস্তিতে উঠে আজ থেকে দশ বছর আগে। তখন পারুর বয়স ছিল পনেরো বছর। দাদি গুলনাহার একটা পোশাক কারখানায় ডাইং এর কাজ পেয়ে যায়। অজানা অচেনা শহরে একটা চাকরি ও মাথা গোজার ঠাঁই পেয়ে দুটি অসহায় নারী বেঁচে-বর্তে যায়। এখন গুলনাহারের বয়স হয়েছে। তার বয়স ষাট। গুলনাহার এতোদিন নাতনিকে কিছু করতে না দিলেও গত এক বছর পারু গুলনাহারকে আর কারখানায় যেতে দিচ্ছে না। দাদির পরিবর্তে সে নিজেই গুলনাহার যে কারখানায় কাজ করতো সেখানে জয়েন করেছে। গুলনাহার প্রথমে বাধা দিলে পরে পারুর জিদ আর নিজের বয়সের কাছে সে বাধা পরাজিত হয়েছে। কারখানার মালিক ভালো। আর অনেকদিন ধরে কাজ করায় গুলনাহার তার বোবা নাতনির জন্য মালিককে ধরে বসলে মালিক প্রথমে আমতা আমতা করলে গুলনাহার বলেছিল -
‘পারু বোবা হলে কী হবে স্যার ও ভালো সেলাইয়ের কাজ জানে। আপনি ওকে সুইং এ লাগিয়ে দিন। দেখিয়ে-শিখিয়ে দিলে দেখবেন ও ঠিক পারবে। বিশ্বাস করুন।’
সেই থেকে শুরু পারুর চাকরি জীবন। পনেরো বছরের বোবা পারু এখন পঁচিশ বছরের যুবতী। লুপ্ত রাজবড়ি যেমন কথা না বলতে পারলেও অবয়বে ধরে রাখে নানান সৌন্দর্যের কারুচিহ্ন। আগত দর্শনার্থী এসে সে রূপ দেখে বিভোর হয়। ছুঁয়ে দেখার তৃষ্ণাবোধ করে পারুর রূপও সেই রকম। ও বোবা বলেই ওর শরীরে সে রূপ আরো বেশি ভাষায়িত ও রেখায়িত হয়ে উঠেছে। তাই কথা বলতে না পারায় নিজের প্রতি ওর আগ্রহ কম থাকলেও শুধুমাত্র রূপের কারণে ওর প্রতি অন্যের আগ্রহের কমতি নেই। চাকরি পেয়ে পারুর শুরু হয় নতুন এক জীবন সংগ্রাম। এতোদিন দাদি তাকে খাইয়েছে পরিয়েছে। এখন সে দাদির দায়িত্ব গ্রহণ করেছে। চাকরিতে জয়েন করার দুইমাস পরে নাসিরাবাদে তার কারখানা হতে আধা কি:মি: দূরে আর একটা কারখানায় চাকরি করা টগরের সাথে পরিচয় ঘটে পারুর। টগরের বাড়ি গাজীপুরের চন্দ্রা। ছোটবেলা মা মারা যাওয়ার পরে বাবা তাকে ঢাকায় একটা এতিমখানায় দিয়ে যায়। এরপর বাবা মোসাদ্দেক মোল্লা তার আর কোনো খোঁজ-খবর নেয়নি। তার বাবা আর একটি বিয়ে করার কথা সে শুনেছিল আরো বছর খানেক পরে। এরও দশ বছর পরে একদিন তার বাবার মৃত্যু সংবাদ পায় সে। এ দশ বছরে মোসাদ্দেক মোল্লা তাকে একটিবারের জন্য দেখতে আসেনি। প্রকৃতি যাকে বোবা করেছে কথা বলার মানবিক অধিকার থেকে যে বঞ্চিত তার প্রতি পিতৃঋণের দায় থাকে না। সে দাবি নিয়ে টগরও কখনো মোসাদ্দেক মোল্লার কাছে দাঁড়ায়নি। এতিমখানাতেই পরিচয় ও বন্ধুত্ব তৈরি হয় বাদলের সঙ্গে। বন্ধুত্ব হরিহর আত্মায় রূপ নেয়। বাদলও এতিম। টগরের পিতা মরার খবর যেদিন এলো তখন তারা কিশোর। সেদিন রাতে তারা দুজন এতিমখানা থেকে পালিয়ে কমলাপুর রেলস্টেশনে এসে চট্টগ্রাম আসার ট্রেন ধরেছিল। চট্টগ্রাম এসে জীবনের রূঢ় বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হয় দুজনকে। প্রথমে একটা জুতো তৈরির কারখানায় কাজ জুটে যায় ওদের। সেখানে দুবছর কাজ করে একটা বিস্কুট তৈরির কারখানায় তিন বছর কাজ করে সেটাও ছেড়ে দেয় ওরা। এরপর বাজারে একটা পুরনো কাপড় বিক্রির দোকানে কাজ পায় টগর। আর নাসিরাবাদ একটা পোশাক কারখানায় চাকরি পেয়ে যায় বাদল। এর আগ পর্যন্ত দুইবন্ধু একই সাথে চাকরি করেছে। এই প্রথম দুজনের দু জায়গায় চাকরি জীবন শুরু হয়। দুজন দুজায়গায় চাকরি করলেও দুজনা চলাচলের সুবিধা এবং বাসাভাড়া কমের জন্য বদ্দারহাটে তারা একসঙ্গে এক রুমের একটা বাসা নিয়ে নেয়। সেখানে থেকেই দুজন রোজ যাওয়া আসা করে। নাসিরাবাদে পোশাক কারখানায় কাজ নেওয়ার তিনবছর পরে বাদল মালিকের কাছে অনেক অনুনয়-বিনয় করে টগরের জন্য তার কারখানায় একটা কাজের ব্যবস্থা করে ফ্যালে। বছর দুই হলো টগর বাদলদের কারখানায় কাটিং সেকশনে জয়েন করেছে। পুরনো কাপড়ের দোকনে কাজ করতে করতে গত তিন বছরে সে কাপড় কাটার কাজটি মালিকের কাছ থেকে ভালো করে রপ্ত করে নিয়েছে। আজ থেকে দশ বছর আগে কমলাপুর রেল স্টেশন ছেড়ে চট্টগ্রাম এসেছিল টগর। তখন সে কিশোর ছিল এখন সে টগবগে যুবক। স্রষ্টা তাকে ভাষাহীন করেছে বটে, কিন্তু তার চোখ দুটি ভাষাদীপ্ত। ঝাঁকড়া চুলের সুঠাম দেহের অধিকারী শ্যামাঙ্গের অধিকারী টগর কথা বলতে পারে না - অপরিচিতদের কেউ এমনটা শুনলে প্রথমে অবাক হয়। পরে টগরকে তারা আপদমস্তক নিরীক্ষণ করে এবং তাদের মুখে একটা অস্ফুট আফসোসের ধ্বনি ‘আহা’ শোনা যায়। টগরের সাথে পারুর পরিচয়ের একমাস পরেই বাদলের চেষ্টায় পারু আর টগরের বিয়ে হয়ে গেল। এর দুই মাস আগে বাদল নাসিরাবাদে তাদের কারখানার সিকিউরিটি গার্ড দেলোয়ারের মেয়ে বৃষ্টিকে বিয়ে করে এনেছে। বাদল চুপচাপ স্বাভাবের হলেও বৃষ্টি চপলা, মুখরা। এই দুই মাসে সে দুই বন্ধুর মধ্যে কেমন যেন সাপের মতো কামনার বিষাক্ত নেশাকে জাগিয়ে তুলতে তৎপর হয়ে উঠেছে। ঘর করে সে বাদলের কিন্তু চোখ থাকে তার টগরের দিকে যেনো। টগর যা মুখ ফুটে চাইতে পারে না, যা বলতে পারে না; যেখানে টগরের সীমাহীন দ্বিধা আর সঙ্কোচ সেখানে বৃষ্টির অবাধ অপরিসীম নিঃসঙ্কোচ বিচরণ। বাদলের রং কালোর দিকে। তবে তা ছাতার কাপড়ের মতো কালো নয়। হ্যাংলা-পাতলা গড়ন। বন্ধু অন্তপ্রাণ মানুষটির কাছে বউ বৃষ্টির আচরণ ক্রমশ দুর্বোধ্য ও রহস্যময় বলে মনে হতে শুরু করেছে। পেটের ব্যথার কথা বলে আজকের বিয়ের অনুষ্ঠানে সে যায়নি। বালিশে মুখ গুঁজে বিছানায় সারাদিন উপুর হয়ে শুয়ে ছিল। বাদল টগরকে দোষারূপ করতে চায় না। টগর পুরুষ মানুষ। হোক সে বোবা। নারীর সাবলীল উপস্থিতি ও সহজাত নিবেদনের ভাষা বোবা পুরুষও বোঝে। তার শরীরেও উদগ্র কামনার বীজ ফোটে। চোখে নেশার মধুরস সৃষ্টি হয়। তার সব কিছু থাকতেও তার বউ কথা বলতে পারে না এমন একজন বোবা মানুষের প্রতি ঝুকলো কেন এটি তার কাছে বড়ই রহস্য মনে হয়। নারী মনের কত খাঁজ, কত তার গোপন কুঠুরি। সব কী পড়া যায় ? আর পুরুষের কাছে সব কী ধরা দেয় ? তার বউ বৃষ্টিই আগুনের উত্তাপ নিয়ে টগরের সামনে হাজির হয়। টগর সে আঁচ থেকে নিজেকে সামলে নেয়ার চেষ্টা করলেও আগুনের ধর্মই হলো তা অন্যের দিকে ধেয়ে আসা। তাই আগুনের কাছাকাছি থাকলে তার ছোঁয়াচ থেকে বাঁচা কঠিন। যে বন্ধুত্ব ভাঙার নয়, হারাবার নয়, বিপন্ন হবার নয় সে বন্ধুকে সংকটের হাত থেকে রক্ষর জন্য বাদল পারুর মতো একটি মেয়েকে খুঁজছিল এবং সেটি মিলেও গেল।
আগে দশ বছর দুই বন্ধু চট্টগ্রাম এসে যে যেখানেই কাজ করুক না কেন এক রুমেই থেকেছে। দুইমাস হলো বাদল আলাদা একটা রুম নিয়েছে। বউকে নিয়ে সে সেখানেই থাকে। বাদলের রুমের পাশের রুমটাতে টগর থাকে। টগর বিয়ে করছে বলে টগরের রুমের সাথে লাগোয়া আরো একটা রুম টগরের নামে ভাড়া নেওয়া হয়েছে। যেহেতু এখন থেকে টগরের সাথে পারু এবং পারুর দাদি গুলনাহার থাকবে এই তিনজনের জন্য দুটি রুম। এটা বস্তিপাড়া বাসাগুলো টিনের ছাপড়া। দুটি ফ্যামিলির জন্য একটি করে রান্নার ঘর আর একটি করে বাথরুম। আশপাশের অন্য বস্তিগুলোর তুলনায় এই বস্তিপাড়াটির বসবাসের ব্যবস্থা ভালো। পরিবেশটাও অতো নোংরা এবং অস্বাস্থ্যকর নয়। তবে ধনী বা মধ্যবিত্তের মতো অতো স্বাস্থ্যকরও নয়। বস্থির গা ঘেঁসে একটা পাউরুটির কারখানা ও একটি শুটকি প্রক্রিয়াজাতকরণের কারখানা আছে। শুটকির গন্ধে গা গুলিয়ে যায়। শুটকির গন্ধের নিচে পাউরুটির ঘ্রাণ চাপা পড়ে যায়। অসুবিধের মধ্যে এটুকুই যা অসুবিধে। তবে যারা নিয়মিত থাকে তাদের ওসব গা সওয়া হয়ে যায়। আর এখানকার মানুষেরা বেশিরভাগই নানা পেশাজীবী ও শ্রমজীবী মানুষ। সারাদিন তারা বাইরে কাজ করে। ঘুমানো ও জৈবিক চাহিদা পূরণের জন্য রাতে তারা ঘরে ফেরে। তাদের সন্তানেরাও সারাদিন ঘরের খোঁজ করে না। বাইরে বাইরে টো টো করে ঘোরে। কুসঙ্গে মেশে, নেশায় আসক্ত হয়। একটু মাথা তোলা হলে যে যার রুটি-রুজির পথ খুঁজে নেয়। দিন শেষে সন্তানদের কে বাসায় ফিরলো, কে ফিরলো না এ নিয়ে বাবা মারা বেশি শংঙ্কিত বা উদ্বিগ্ন থাকে না। তারা ভেবে নেয় আজ না ফিরলে কাল ফিরবে নয়তো পরশু। কোথাও আছে নেশা ভান খেয়ে বন্ধুদের সাথে পড়ে। মরে না গেলে নিশ্চয় ফিরবে। পড়াশোনার ধার তারা ধারে না। এ বস্তির নারী-পুরুষ তাই দৈহিক তাড়নায় ও প্রবৃত্তির নিবারণে মিলিত হয়, নারীর গর্ভে সন্তানও আসে শরীরবৃত্তীয় নিয়মে এবং সে সন্তানের ছন্নছাড়া হয়ে বেড়ে ওঠার প্রক্রিয়াটিও সহজাত নিয়ম বলেই এখানকার বাসিন্দারা মনে করে। শুটকির কারখানা থাকায় এখানে বাসা ভাড়া কম। কনেকে বরের বাসায় নেয়ার জন্য কোনো টমটম, কার বা মাইক্রোবাসের ব্যবস্থা ছিল না। রিকসায় সম্বল। দুটি রিকসা ভাড়া করে চারজন মানুষ চড়ে বসতেই আকাশে মেঘের ডাক শুনতে পেল সবাই। গুলনাহার ও বাদল একটি রিকসায় চড়েছে। অন্যটিতে টগর পারু। রিকসা চলতে শুরু করেছে। নাসিরাবাদ থেকে বদ্দারহাট রিকসা পথ। বাসেও আসা যায়। নতুন বউকে নিয়ে লোকাল বাসে না উঠে টগর রিকসা নিয়েছে। রিকসায় আধা ঘন্টা থেকে পঁয়তাল্লিশ মিনিট সময় লাগে। রওয়ানা দিতে দিতে সাড়ে দশটা বেজে গেল। টগর হাত ঘড়িটা দেখে নিলো রাত পৌনে এগারোটা বাজে। চারিদিক দিয়ে একটা হাওয়া বইছে। রিকসায় হুড তোলা। রাস্তায় গাড়ির সংখ্যাও কমে এসেছে। রাস্তা সুনশান নীরব। মাঝে মাঝে দু একটা সিটি বাস হর্ন বাজিয়ে রিকসার কোল ঘেঁসে চলে যাচ্ছে। হেলপারের কণ্ঠে এই নাসিরাবাদ, চাঁকদা, চকবাজার, স্টেশনরোড ডাক শোনা যাচ্ছে। বাসগুলো যখন তাদের রিকসা ক্রস করছে টগর খেয়াল করলো পারু টগরের বামহাত শক্ত করে জড়িয়ে ধরছে। হয়তো সে ভয় পেয়ে এমনটা করছে। টগর পারুর মাথার উপর ডান হাতটা রেখে স্মিত হেসে ইশারা করে বুঝালো ভয় পেয়ো না আমি আছি। ঘোমটার আড়াল থেকে আঁধারেও যেন বিদ্যুৎ রেখার মতো টগরের মনের কথা বুঝে খুশিতে পারুর চিবুক নড়ে উঠলো। রিকসার ভেতরে দুজনার শরীর দুজনার সাথে পাশাপাশি ঠেসে লেগে আছে। দুজনার শরীর থেকে বের হচ্ছে গাঁদা ফুলের ঘ্রাণ। টগরের ঘরের চাবি বৃষ্টির কাছে রেখে গিয়েছিল। ফুলের দোকানে দুটি ছেলেকে বলা ছিল তারা এসে বৃষ্টির কাছ থেকে চাবি নিয়ে টগরের ঘর খুলে বাসরঘর সাজিয়ে দিয়ে গেছে। কোনটি রুমটি বাসর ঘর হবে টগর তা ছেলে দুটিকে আগেই দেখিয়ে দিয়েছিল। সন্ধ্যার পর ঘর সাজিয়ে ছেলে দুটি বৃষ্টিকে চাবি দিয়ে চলে গেছে। সাজানো শেষ হলে ছেলে দুটি বৃষ্টিকে ডেকে ঘরটা দেখতে বললে বৃষ্টি প্রথমে রাজি না হলেও ছেলে দুটির অনুনয়-বিনয়ে শেষ-মেশ বিছানা ছেড়ে উঠে গিয়ে সে যখন টগর আর পারুর বাসর ঘরের সামনে দাঁড়িয়েছিল তখন বুকের খুব গভীর থেকে একটা তপ্ত নিঃশ্বাস বের হয়ে এসে তার বুকে তা আছড়ে পড়ে বুকটা যেন পুড়িয়ে খাক করে দিয়েছিল। বাসর ঘর টগর সাজাতে চাইনি। বাদল টাকা দিয়েছে। বাদল সাজিয়ে দিয়েছে টগরের বাসর ঘর। বলেছে বন্ধুর তরফ থেকে এটা বন্ধুর জন্য উপহার। টগর বন্ধুকে বুঝিয়েছিল বোবা মানুষের আবার বাসর কিসের? বাদল শোনেনি টগরের কথা। তার স্বামীর কেনা গোলাপের ভাঁজে ভাঁজে পারুর ভালোবাসার উপাখ্যান রচিত হবে। টগরের ঝঁকড়া চুলে, সুঠাম দেহে বোবা পারুর দেহের বুদবুদ জাগবে, ভাষার জোয়ারে ভাসবে না। আর সেখানে সেতারের মতোন দেহ সৈষ্ঠবে বৃষ্টি চাইলেই ছিপছিপে ডিঙি নৌকা হয়ে টগরের দেহে ভাবে ও ভাষায় কাম ও প্রেমের বান ডেকে আনতে পারতো। সাড়ে এগারোটায় যখন বর-কনে সমেত বাদল বাসায় পৌঁছালো ততক্ষণে বৃষ্টির চোখ নিদ্রাচ্ছন্ন হয়ে এসেছে। দরজায় কড়া নাড়ার শব্দে সে জেগে উঠে বসলো। জেগে থাকতে থাকতে সে ঘুমিয়ে পড়েছিল। চোখ দুটি তার ভীষণ জ্বালা করছে। পাতা দুটিও ফোলা এবং ভারী। বেশ খানিকটা সময় কেঁদেছেও সে। এ কান্নার কোনো ব্যাখ্যা নেই। দরজার কড়া নাড়ার শব্দে চোখ দুটি কচলে নিল সে। কাক ঘুম এসেছিল সে। চোখ জ্বালা করার পাশাপাশি বুকটাও কেন যেন জ্বলতে শুরু করলো তার। আলাদা কোনো শাড়ি সে পরেনি। সাজগোছও সে করেনি। যাওয়ার সময় বাদল তাকে একটু সাজগোছ করতে বলেছিল। কানটা খাড়া করলো সে। আর একবার দরজার কড়া নড়ার শব্দ শুনলো। তারপর টিনের চালে টিপটিপ বৃষ্টির শব্দ শুনতে পেল সে। বুকের স্খলিত কাপড়টা টেনে বিছানা থেকে নেমে দরজার শেকল খুলেই সে টগর ও পারুকে দেখতে পেল। কোনো প্রেমিক দীর্ঘদিন প্রেম করে প্রেমিকাকে না বলে কয়ে অন্য কোনো নারীকে বিয়ে করে সদ্য বিবাহিতা বউকে প্রেমিকার সামনে হাজির করলে প্রেমিকার মুখের ভাবান্তর যেমনটি হয়, বৃষ্টির চেহারাটাও এই মহূর্তে তেমনটি দেখলো। কোনো নারীর বিধবা হওয়ার সংবাদ নিশ্চিত হলেও চেহারাটা এতোটা ম্লান ও ফ্যাকাশে দেখায় না। দুটি বোবা ভাষাহীন মানুষের বাসর রাতে ভাষার আবেদন নিয়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। যে মনোযন্ত্রণা নিয়ে বৃষ্টির আজ সারাদিন কেটেছে। তার খবর কে রেখেছে ? আহত পাখির মতো তার মনের ছটফটানি তো কেউ দেখেনি। যাকে পাবে না জানলেও সান্নিধ্যটুকু পাওয়া যাবে এতদিন এ নিশ্চয়তাটুকু ছিল। আজ সে সান্নিধ্য পাওয়ার সুখটুকুও খোয়া গেল। আজ সে চিরদিনের মতো পারুর হয়ে গেল। টগরের সাথে তার সম্পর্ক দেবর-ভাবির হলেও বিয়ের আগে টগরের পুরুষ হৃদয়কে সে তার নারী মন দিয়ে একাকী অধিকার-অনধিকারের মাধ্যমে অনেকখানি দখল করে রেখেছিল। অলিখিত সে অধিকারের মধ্যে টগরও খানিকটা বাধা পড়েছিল। নারী সঙ্গহীন বোবা পুরুষ বন্ধুর স্ত্রী জেনেও বৃষ্টির সঙ্গ সবসময় এড়িয়ে যেতে পারেনি। পারু আসার আগে সেখানে ছিল বৃষ্টির একক কর্তৃত্ব ও দখলদারিত্ব। আজ সে দখলস্বত্ব কড়াই-গণ্ডায় বুঝে নেবে পারু। বোবা বলে তার এক কানা কড়িও ছাড় দেবে না। বুকের যে জ্বালায় সারাদিন জ্বলছিল বৃষ্টি তাতে ঘি ঢেলে তেজ আরো উসকে দিয়ে সে জ্বালা দ্বিগুণ করে তাকে বধূবরণ করতে হলো না। ঝমঝমিয়ে নামা বৃষ্টি তাকে সে যন্ত্রণা থেকে রক্ষে করলো। কোনো রকমে পরিচয় পর্বটুকু সেরে যে যার মতো দৌড়ে ঘরে উঠে গেল।
দুটি বোবা মানুষের বাসর এর চেয়ে আর কী আড়ম্বরতায় হতে পারে ? বাদলের সৌজন্যে সাধারণ একটা চৌকি গোলাপ ও রজনীগন্ধা দিয়ে সাজানো হয়েছে। পায়ের কাছে জানালাটা বন্ধ রাখা হয়েছে যেন শুটকি কারখানার আঁশটে গন্ধ ভেতরে না ঢুকে পড়ে। তবুও বৃষ্টি ও বাতাসের ঝাপটার সঙ্গে সে গন্ধ গোলাপ ও রজনীগন্ধার সাথে মিশে হলেও দুজনার নাকে এসে খানিকটা ধাক্কা খেল। পারু গন্ধটায় নাক কুচকে টগরের দিকে তাকাতেই টগর বিষয়টি বুঝতে পেরে পারুকে ইশারায় সবটা বুঝিয়ে বলল। গুলনাহার তার ঘরে ঢুকে গেছেন। রাতের খাবার তারা সাথে করে নিয়ে এসেছে। কিন্তু কারো কোনো খাবার ইচ্ছে নেই। গুলনাহার পোশাক বদলে এসে তাদের সাথে দেখা করে বলে গেলেন। তখন রাত প্রায় পৌনে একটা বাজে। তিনি ঘুমোতে যাচ্ছেন। তিনি কিছু খাবেন না। পারু ও টগরকেও ঘুমিয়ে পড়তে বললেন। বললেন বাইরে বষ্টি হচ্ছে ওদের যদি কোনো কিছু দরকার হয় তবে ওরা যেন তাকে ডাক দেন। কথাগুলো গুলনাহার বলে চলে গেলেন। পারু ও টগর চৌকিতে পা ঝুলিয়ে বসে ছিল এতক্ষণ। পারু ঘোমটা সরিয়ে ইশারায় টগরকে উঠে দাঁড়াতে বলল। টগর উঠে দাঁড়ালে পারু টগরের পায়ে হাত দিয়ে সালাম করে দাঁড়ালে টগর ডানহাত দিয়ে পারুর থুতনিটা উঁচু করে ধরতেই দেখলো পরম আবেশে পারুর চোখ দুটি বোজা। ঠোঁট দুটি ঈষৎ কাঁপছে। এই মুহূর্তে বুকটাও কী দুরু দুুরু করছে পারুর ? পারুকে বুকে জড়িয়ে ধরলো টগর। দুটি বোবা মানুষের জীবনে এর চেয়ে আনন্দের ক্ষণ আর কী হতে পাওে ? সারা বিশ্ব না জানুক এই বৃষ্টি ভেজা রাত আর পারুর খোপার গাঁদা আর ঘরের গোলাপ, রজনীগন্ধরা জানুক আজ ওদের বাসর। কিন্তু জীবন তো এমন নিরবিচ্ছিন্ন সুখের আধার নয়। বিয়ের পর আবার যে যার মতো কর্মব্যস্ত হয়ে পড়ল সবাই। কেবল ব্যস্ততা নেই বৃষ্টির। গুলনাহার বয়স্ক মহিলা হলেও সে নিজে বাজার করে। টগর ও পারুর জন্য রান্না-বান্না করে। সাংসারিক কাজকর্ম করে তার দিন কেটে যায়। মাঝে-মধ্যে বৃষ্টিকে ডেকে নিয়ে বৃষ্টির সঙ্গে গল্প-গুজব করে। তবে সে গল্প-গুজবে বৃষ্টির ভেতরে সাড়া থাকে না। তার মন অন্য কোথাও পড়ে থাকে। রাতে তার স্বামী বাদল, টগর আর পারু বেশিরভাগ দিন একসাথে ফেরে। কখনো কখনো আলাদা ফেরে। তবে টগর ও পারু সব সময় একসাথে আসে। যত রাতই হোক টগরকে এক নজর না দেখলে তার ভোলো লাগে না। সে জানে এটা পাপ। কিন্তু এ পাপ থেকে সরে আসার উপায়ও তার জানা নেই। বিয়ের দুই মাস যেতেই বৃষ্টির ব্যাপারটা বোবা হলেও পারু বুঝে ফেলছে। সে বিষয়টি টগরকে ইশারা ইঙ্গিতে বুঝিয়েছে এবং এ বাসা ছেড়ে অন্যত্র চলে যাওয়া বাসনার কথাও টগরকে জানিয়েছে। টগর বাদলের বন্ধুত্বের কথা বলে পারুকে বলেছে আর দুই-এক মাস সবুর করতে। এর মধ্যে বৃষ্টির আচরণ ঠিক না হলে তারা বাসা পরিবর্তন করবে। তবে বৃষ্টি আগের চেয়ে অনেক নির্লিপ্ত হয়ে গেছে। এখন সে টগরের দিকে কেবল হ্যাংলার মতো চেয়ে থাকে। কথা-বার্তা কম বলে। বাদল এ নিয়ে বৃষ্টির সাথে অনেক কথা কাটাকাটি পর্যন্ত করেছে। তবে ইদানিং বৃষ্টির আচরণ দেখে বাদল মনে মনে ভেবেছে বোধহয় বৃষ্টি নিজের ভুল বুঝতে পেরেছে। বৃষ্টি বোধ হয় ঠিক হয়ে গেছে। কিন্তু বাদলের একথা জানা নেই পরকীয়া প্রেমের ঘুণ একবার যারে ধরে তাকে তা কেটে কেটে নিঃস্ব না করা পর্যন্ত ছাড়ে না। তাই বৃষ্টিও ভেতরে ভেতরে নিঃস্ব হতে শুরু করেছে। টগর ও পারুর বিয়ের দুইমাস পরে একদিন টগরের ভীষণ জ্বর এলো। পারু অসুস্থ টগরকে দাদি গুলনাহারের কাছে রেখে কারখানায় গেল ডিউটিতে। বাদলও সকালবেলা বন্ধুর কাপলে হাত দিয়ে দেখে বলল তোর গা ভালোই গরম। তোর আজ কারখানায় গিয়ে কাজ নেই। আমি ম্যানেজারকে তোর জ্বরের কথা জানিয়ে দেব। বৃষ্টি ও দাদি থাকবে তোর দেখাশোনা করবে। ঘরে কোনো বাজার-সদায় না থাকায় গুলনাহার বৃষ্টিকে টগরের কাছে রেখে বেলা বারোটার দিকে বাজারে গেলে বৃষ্টির এতোদিনের টগরকে ঘিরে অবদমিত কামনা যেন জনমানব শূন্য ঘরটায় বাধ-ভেঙে গেল। গুলনাহার চলে যেতেই সে টগরের জ্বরতপ্ত কপালটা আচমকা চম্বুনে চম্বুনে ভরিয়ে দিতে লাগলো। টগর গোঙরানির মতো একটা শব্দ করে বৃষ্টিকে জ্বরতপ্ত দুর্বল দুহাত দিয়ে সরিয়ে দিতে চেষ্টা করলো কিন্তু বৃষ্টি চিনে জোকের মতো সবলে শায়িত টগরকে দুবাহু ডোরে জড়িয়ে ধরে টগরের বুকে মুখ গুঁজে বলতে লাগলো তুমি এতো পাষাণ কেন? আমার কষ্ট তুমি বোঝ না ? আমার জ্বর তো তোমার বিয়ের দিন থেকে। আমার অন্তর পুড়ে খাক হয় তুমি দ্যাখো না। তোমার বন্ধু আমারে মারে-কাটে। তারপরেও তো আমি তোমারে ভালোবাসি। তুমি কথা কও তুমি আমারে ভালোবাসো না। ওই বোবা মাগী তোমারে কিচ্ছু দিতে পারবো না। আমি তোমারে ভাষা দিব। আশা দিব। সাহস দিব। বল দিব। ভালোবাসা দিব। আমি তোমার বোবা মুখে কথা হবো। চলো এখান থেকে আমরা দুজন পালায়ে যায়।
টগর গোঙরানি দিয়েই চলেছে। জ্বরে তার গা পুড়ে যাচ্ছে। সে বৃষ্টির বাহুডোর থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য ছটফট করছে। তার কপলে ঘাম জমেছে। তবুও বৃষ্টি তাকে ছাড়ছে না। হঠাৎ একটা আলাদা গোঙরানির শব্দ শুনে দুজনার চোখ গেল ভেড়ানো দরজার দিকে। দরজা ভেতর থেকে লাগানো ছিল না। ভেড়ানো ছিল মাত্র। দরজা খুলে পারু বিছানায় দুজনকে এমন অবস্থায় দেখে ক্ষিপ্র চিতার মতো বৃষ্টির ওপর ঝাপিয়ে পড়ে বৃষ্টির চুলের মুঠি ধরে ফেললো। চুলাচুলি কাণ্ড যখন শুরু হয়ে গেছে তখন বাজার নিয়ে ঢুকলো গুলনাহার। গুলনাহার বিষয়টা কিছুটা আচ করতে পেরে তখনকার মতো দুজনকে নিরস্ত করলো। টগর অসুস্থ থাকায় পারু ম্যানেজারকে বলে আগে চলে এসে যা দেখেছে তার বর্ণনা ইশারায় দাদিকে বোঝাতে গুলনাহার বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে বললো - ‘ছি বউমা তোমাকে তো আমি ভালো বলে জানতাম। সেই তুমি এমন করতে পারলে। আজ রাতে বাদল আসুক এর একটা বিহিত হওয়া দরকার।’ বৃষ্টি কাঁদতে কাঁদতে ঘরে ফিরে গেল।
রাতে বাদল ফিরলে ঘটনা জেনে সে ভীষণ লজ্জিত হলো। টগরের জ্বর এখনো আছে। বন্ধুর জন্য তার কষ্ট হলো। বৃষ্টির জন্য তার করুণা হলো। বৃষ্টিকে কয়েকটা চড় থাপ্পড় দেওয়ার পর মনে মনে ভাবলো আগামীকাল সকালে সে তার বউকে বাপের বাড়ি দিয়ে আসবে। গুলনাহার সাফ জানিয়ে দিয়েছে টগরের জ্বর ভালো হলে তারা এ বাসা ছেড়ে সামনে মাসে অন্যত্র কোথায় বাসা দেখে উঠে যাবে। তবে বন্ধুত্ব তাদের থাকবে। পাশাপাশি বসবাস করবে না এই যা। রাতে বৃষ্টি কোন কিছু খেল না। বাদলের সাথে কথাও বললো না। শুয়ে পড়লো চুপচাপ। বাদল ভাবলো বউকে গায়ে হাত তোলায় রাগ করেছে তাই কথা বলছে না। রাগ পড়লে কথা বলবে ঠিক। তবে অন্য দিনের মতো মারধোরের পরে আজ বৃষ্টি কান্না-কাটি করেনি। কেবল নিরব চোখে বাদলের দিকে চেয়ে ছিল কিছুক্ষণ। রাতে সে চুপচাপ বাদলের পাশে শুয়ে পড়লো।
সকালবেলা বাদলের চিৎকারে বস্তির সবার ঘুম ভাঙলো। ঘটনা হলো এই বৃষ্টি শাড়ি পেচিয়ে ফ্যানের সিলিংয়ের সঙ্গে গলায় দড়ি দিয়েছে। ঘরের ভেতরে শূন্যে ঝুলছে বৃষ্টির নিথর দেহটি। মৃত মুখে নেই কারো ওপর কোন রাগ, ক্ষোভ, ঘৃণা। বস্তিবাসী কেউ বুঝতে পারলো না কেন এই আত্মহত্যা? কেবল চারজন ব্যক্তি জানলো এই মৃত্যুর কারণ। একটু বেলা হলে পুলিশ এলো। ডেডবডি নামানো হলো। ময়না তদন্তের জন্য লাশ পাঠানো হলো মর্গে। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য বাদলকে পুলিশ হেফাজতে থানায় নেওয়া হলো। টগর ও পারু বোবা জেনেও পুলিশ টগর, পারু ও তাদের দাদি গুলনাহারকে বাসা থেকে কোথাও না যাওয়ার নির্দেশ দিল। প্রয়োজনে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাদেরকে থানায় ডাকা হবে বলে জানানো হলো। পুলিশ প্রাথমিক তদন্তে ধারণা করলো এটা একটা পরকীয়া প্রেম ঘটিত আত্মহত্যা। কিন্তু তারা বুঝতে পারলো না এই প্রেম কী একতরফা শুধু মেয়েটির দিক থেকে ছিল নাকি বোবা ছেলেটিরও কোনো ধরনের মানসিক সাড়া ছিল ?
No comments:
Post a Comment
Thank u very much