Sunday, August 8, 2021

'বঙ্গমাতার অনুপ্রেরণা ও আত্মোৎসর্গ' লেখক মোঃ মোফাজ্জেল হক

 

বঙ্গমাতার অনুপ্রেরণা ও আত্মোৎসর্গ 

মোঃ মোফাজ্জেল হক।

[সভাপতি বঙ্গবন্ধু শিক্ষা ও গবেষণা পরিষদ কুষ্টিয়া জেলা শাখা।সদস্য তথ্য ও গবেষণা উপকমিটি বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ।]

বঙ্গবন্ধুর জীবনাদর্শ আলোচনায় বঙ্গমাতার জীবনাচারও অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে উদ্ভাসিত। খোকা থেকে মুজিব, মুজিব থেকে মুজিব ভাই, মুজিব ভাই থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব , বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব থেকে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, জাতির পিতা থেকে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙ্গালী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হয়ে ওঠার পেছনে যার অবদান অনস্বীকার্য, তিনি হচ্ছেন বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব।বঙ্গমাতার অনুপ্রেরণা ও আত্মোৎসর্গ অনস্বীকার্য। তার কারণেই একটি জাতির মনে স্বাধীনতার স্বপ্ন বপন করে এর স্বাদও এনে দিতে পেরেছিলেন বঙ্গবন্ধু। তার রাজনৈতিক দর্শন ও আদর্শকে বাস্তবায়ন করতে পেছন থেকে কাজ করেছেন শেখ মুজিবের প্রিয় রেণু।

মহীয়সী নারীর এমন দৃঢ়প্রত্যয় সাহস জোগানোর ফলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সেদিন ৭ই মার্চের অমর ভাষণ দিয়েছিলেন, বাঙালি জাতিকে মুক্তির পথ দেখিয়েছিলেন, ৭ই মার্চের ভাষণের নেপথ্য শক্তি—তিনি বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব। ডাকনাম রেণু। ১৯৩০ সালের ৮ আগস্ট ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জ মহকুমার টুঙ্গিপাড়া গ্রামে তাঁর জন্ম। পিতা শেখ জহুরুল হক ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমানের জ্ঞাতি সম্পর্কের চাচা এবং গ্রামের বর্ধিষ্ণু কৃষক পরিবার। 



বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর আত্মজীবনীতে উল্লেখ করেছেন, ‘একটা ঘটনা লেখা দরকার, নিশ্চয়ই অনেকে আশ্চর্য হবেন। আমার যখন বিবাহ হয় তখন আমার বয়স বারো-তেরো বছর হতে পারে। রেণুর বাবা মারা যাবার পরে ওর দাদা আমার আব্বাকে ডেকে বললেন যে আমার সাথে তার এক নাতনির বিবাহ দিতে হবে। কারণ তিনি তাঁর সমস্ত সম্পত্তি ওদের দুই বোনকে লিখে দিয়ে যাবেন। রেণুর দাদা আমার আব্বার চাচা। মুরব্বির হুকুম মানার জন্যই রেণুর সাথে আমার বিবাহ রেজিস্ট্রি করে ফেলা হলো। আমি শুনলাম আমার বিবাহ হয়েছে। তখন কিছুই বুঝতাম না, রেণুর বয়স তখন বোধ হয় তিন বছর হবে। রেণুর যখন পাঁচ বছর বয়স তখন তার মা হোসনে আরা বেগম মারা যান। একমাত্র রইল তার দাদা। রেণুর সাত বছর বয়সে দাদাও মারা যান। তারপর সে আমার মায়ের কাছে চলে আসে। রেণুদের ঘর আমার ঘর পাশাপাশি ছিল, মধ্যে মাত্র দুই হাত ব্যবধান।’ 


শেখ মুজিবের মা বেগম সায়রা খাতুন পাঁচ বছর বয়সে মাতৃহীন রেণুকে ঘরে তুলে নেন এবং নিজের ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে শিক্ষাদীক্ষা ও গৃহকর্মে বড় করে তোলেন। শৈশব থেকেই রেণু শেখ মুজিবসহ পরিবারের ছোট-বড় সব সদস্যের কাছে নিজেকে আপন হিসেবে গড়ে তুলতে সচেষ্ট ছিলেন। বিশেষ করে বড় সন্তান খোকা (শেখ মুজিবের ছোটবেলার ডাকনাম), যাঁর সঙ্গে তাঁর বিশেষ সম্পর্ক, তাঁর চলাফেরা, কিশোর বয়স থেকেই নানা কর্মকাণ্ড, খানিকটা দুরন্তপনা, বেপরোয়া ও সাহসী মনোভঙ্গি কিশোরী ফজিলাতুন নেছা রেণুর জন্যও বড় হওয়ার প্রেরণা ও মুগ্ধতার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। মানুষের যেকোনো বিপর্যয়ে, অসুখ-বিসুখে উদ্ধারকর্মী হিসেবে শেখ মুজিবের সঙ্গে নিজেও তাঁর পাশে গিয়ে দাঁড়ান। 

বঙ্গবন্ধু তাঁর আত্মজীবনীর প্রথম পাতা শুরু করেছিলেন সঙ্গী সহধর্মিণীর কথা দিয়ে। কেননা বেগম মুজিবের তাগিদেই এই প্রজন্মের বাঙালি আজ হাতে পেয়েছে স্বাধিকার আন্দোলনের এক অমূল্য দলিল। বঙ্গবন্ধু তাঁর জীবনের কাহিনি রচনার পেছনে স্ত্রীর যে উদ্যোগ ও উৎসাহ পেয়েছেন তাঁর বর্ণনায় লিখেছেন—  “আমার স্ত্রী আমাকে কয়েকটা খাতাও কিনে জেল গেটে জমা দিয়ে গিয়েছিল। জেল কর্তৃপক্ষ যথারীতি পরীক্ষা করে খাতা কয়টা আমাকে দিয়েছেন। রেণু আরো একদিন জেল গেটে বসে আমাকে অনুরোধ করেছিল। ‘বসেই তো আছ, লেখো তোমার জীবনের কাহিনি।’ বললাম, লিখতে যে পারি না; আর এমন কী করেছি যা লেখা যায়! আমার জীবনের ঘটনাগুলো জেনে জনসাধারণের কি কোনো কাজে লাগবে? কিছুই তো করতে পারলাম না। শুধু এইটুকু বলতে পারি, নীতি ও আদর্শের জন্য সামান্য একটু ত্যাগ স্বীকার করতে চেষ্টা করেছি।” 


সেই ছোট্টবেলা থেকে এবং পরবর্তীকালে স্বামীর রাজনৈতিক জীবনের এক আত্মত্যাগী সহযোগী হয়ে ওঠেন বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব। শেখ মুজিবের রাজনৈতিক সংগ্রাম, আন্দোলন ও কারাজীবনেও তিনি এক অনুকরণীয় ত্যাগী নারী হিসেবে আদর্শ স্থাপন করে গেছেন। স্ত্রী হিসেবে তাঁর জীবনকালে কখনো স্বামীকে একনাগাড়ে দুই বছর কাছে পাননি। কিন্তু কোনো দিন কোনো অনুযোগ-অভিযোগ ছিল না, কখনো বলেননি যে তুমি রাজনীতি ছেড়ে দাও, চলে আসো বা সংসার করো বা সংসারের খরচ দাও। জীবনে কোনো প্রয়োজনে কোনো দিন বিরক্ত হননি। যত কষ্টই হোক কখনো ভেঙে পড়তে দেখা যায়নি তাঁকে।


একদিকে ছোট ছোট ছেলে-মেয়ে নিয়ে সংসার সামলানো, আবার কারাগারে গিয়ে স্বামীর সঙ্গে সাক্ষাত্ করে তাঁর মনোবল দৃঢ় রাখা; অন্যদিকে আইনজীবীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে মামলার খোঁজখবর নেওয়া। নিজের সোনার অলংকার বিক্রি করেও মামলার খরচ জুগিয়েছেন। নিজেকে বঞ্চিত করে তিনি স্বামীর আদর্শ ও সংগঠনের জন্য নিজের সম্বল প্রায় সবই বিলিয়ে দিয়েছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, তাঁর স্বামী দেশের জন্য কাজ করছেন, মানুষের কল্যাণের জন্য করছেন। টাকার অভাব, সংসার চালাতে হচ্ছে, আওয়ামী লীগের নেতাদের সাহায্য দরকার, কেউ অসুস্থ তাকে টাকা দিতে হচ্ছে। কিন্তু কখনোই এসব কথা কাউকে বলতেন না। নীরবে কষ্ট করে সমস্যার সমাধান করেছেন।


এমনও দিন গেছে মামলা চালাতে গিয়ে তাঁর কাগজপত্র, উকিল জোগাড় করতে অনেক খরচ হয়ে গেছে। এদিকে বাজারও করতে পারেননি। কোনো দিন বলেননি যে টাকা নাই, বাজার করতে পারলাম না। চাল-ডাল দিয়ে খিচুড়ি রান্না করেছেন। আচার দিয়ে ছেলে-মেয়েদের বলেছেন যে প্রতিদিন ভাত-মাছ খেতে ভালো লাগে নাকি। আসো, আজকে আমরা গরিব খিচুড়ি খাই, এটা খেতে খুব মজা। একজন মানুষ, তাঁর চরিত্র কতটা সুদৃঢ় থাকলে যেকোনো অবস্থা মোকাবেলা করার মতো ক্ষমতা ধারণ করতে পারেন। বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে পদে পদে তিনি আওয়ামী লীগকে শক্তিশালী করার ব্যাপারে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে গেছেন। প্রকাশ্যে প্রচারে কখনোই আসেননি।


১৯৬৬ সালে ছয় দফা দেওয়ার পর বঙ্গবন্ধু প্রথম তিন মাসে আটবার গ্রেপ্তার হন। পাকিস্তান সরকার ৮ মে বঙ্গবন্ধুকে আবার গ্রেপ্তার করে কারাগারে প্রেরণ করে। ৭ জুন ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু ও আটক নেতাদের মুক্তির দাবিতে ধর্মঘট সফলভাবে পালনে বেগম মুজিবের ভূমিকা ছিল অন্যতম। গোয়েন্দা সংস্থার নজরদারি লুকিয়ে ছেলে-মেয়েদের নিয়ে তাঁদের ছোট ফুফুর ফ্ল্যাট বাসায় চলে যেতেন। ওখানে গিয়ে নিজের স্যান্ডেল বদলাতেন, কাপড় বদলে, বোরকা পরে একটা স্কুটার ভাড়া করে ঢাকায় পড়ুয়া ছোট ভাইকে নিয়ে ছাত্রনেতা আর আওয়ামী লীগের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করতেন। আন্দোলন চালাবে কিভাবে তার পরামর্শ, নির্দেশনা তিনি নিজেই দিতেন। আবার ওই বাসায় ফিরে এসে ছেলে-মেয়েদের নিয়ে নিজের বাসায় ফিরতেন। বঙ্গবন্ধু ও আটক নেতাদের মুক্তির দাবিতে সারা দেশে এই ধর্মঘট যাতে পালিত হয় এবং চলমান আন্দোলনের সফলতার জন্য তিনি নিরলস কাজ করে যেতেন। সবই করতেন গোপনে এবং রাজনৈতিক মেধায়। 


একটা সময় এলো ছয় দফা, না আট দফা? পশ্চিম পাকিস্তান থেকে নেতারা চলে এলেন ঢাকায়। তদানীন্তন শাহবাগ হোটেলে থাকতেন নেতারা। বেগম মুজিব মাঝে মাঝে বড় মেয়ে হাসুকে (বর্তমান প্রধানমন্ত্রী মাননীয় শেখ হাসিনা) পাঠাতেন তাঁদের স্ত্রীদের একটু খোঁজখবর নিয়ে আসার জন্য, আর সেই সঙ্গে কে কে আছে একটু দেখে এসে তাঁকে জানাতে। ছোট ভাই রাসেলকে সঙ্গে নিয়ে রুমে রুমে গিয়ে সব দেখেশুনে মাকে এসে রিপোর্ট দিতেন শেখ হাসিনা। বেগম মুজিবের একটা ভালো নেটওয়ার্ক ছিল সারা দেশে। কোথায় কী হচ্ছে তার সব খবর চলে আসত তাঁর কাছে। সবার সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন তিনি। রাজনৈতিকভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণে অনেক নেতাই বেগম মুজিবের প্রতি আস্থাশীল ছিলেন।


আওয়ামী লীগের মধ্যে সে সময় খুব গোলমাল। একদল পিডিএমএ যোগদান করার পক্ষে, আর একদল ছয় দফা। ১৯ মে ১৯৬৬ সালে ৩২ নম্বর ধানমণ্ডির বাড়িতে ওয়ার্কিং কমিটির বর্ধিত সভা। ডেকোরেটর, ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট সে যুগে ছিল না, নিজ হাতে রান্না করে তিন দিন সবাইকে খাইয়েছেন বেগম মুজিব। সঙ্গে বিভক্ত নেতাদের নানা পরামর্শ দিয়েছেন, সাবধান করেছেন যেন ছয় দফা থেকে আট দফার দিকে চলে না যায়। বেগম মুজিবের মানসিক দৃঢ়তা সেই সময়ের রাজনৈতিক জাতীয় সংকট উত্তরণে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত অত্যন্ত কার্যকর ছিল।


নেতাদের নানামুখী পরামর্শে তিনি শুধু বলতেন, ‘লেখাপড়া জানি না কী বুঝব, খালি এটুকু বুঝি যে ছয় দফা আমাদের মুক্তির সনদ, এর বাইরে আমি কিছু জানি না।’ জেলখানা থেকে শেখ মুজিব দৃঢ় উচ্চারণে জানিয়ে দিয়েছেন, আর যাই হোক ছয় দফা থাকতেই হবে। ছয় দফা থেকে একচুল এদিক-ওদিক হওয়া যাবে না। বিশেষ কাউন্সিলের সভায় সিদ্ধান্ত হলো ছয় দফা ছাড়া আর কিছু হবে না।


বেগম মুজিবের স্মরণশক্তি ছিল অসাধারণ। একবার যা শুনতেন তা আর ভুলতেন না। স্লোগান থেকে শুরু করে অনেক রাজনৈতিক পরামর্শ, নির্দেশনা ও সিদ্ধান্ত আসত বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে।


১৯৬৬ সালে শেখ মুজিব গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে থাকাকালে প্রতিদিন কী বিপুল আগ্রহে স্ত্রীর আগমনের প্রতীক্ষায় থাকতেন তা তাঁর লেখনীতে দেখতে পাই। ঘরে-বাইরে বেগম মুজিবই ছিলেন তাঁর পরামর্শক, উপদেষ্টা, সহচর আর নির্ভরতার আশ্রয়স্থল। সে সময়ের লেখা কারাগারের রোজনামচা থেকে কিছু অংশ তুলে ধরা হলো।


১৫ জুন ১৯৬৬  দুঃখ করে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘মাত্র ২০ মিনিট সময় যাবতীয় আলাপ করতে হবে। কথা আরম্ভ করতেই ২০ মিনিট কেটে যায়। নিষ্ঠুর কর্মচারীরা বোঝে না যে স্ত্রীর সাথে দেখা হলে আর কিছু না হউক একটা চুমু দিতে অনেকেরই ইচ্ছা হয়, কিন্তু উপায় কী? আমরা তো পশ্চিমা সভ্যতায় মানুষ হই নাই। তারা তো চুমুটাকে দোষণীয় মনে করে না। স্ত্রীর সাথে স্বামীর অনেক কথা থাকে, কিন্তু বলার উপায় নাই।’


২৬ জুন ১৯৬৬  রেণু স্যারিডন খেতে দিতে চাইত না। ভীষণ আপত্তি করত। বলত, হার্ট দুর্বল হয়ে যাবে। বলতাম, আমার হার্ট নাই, অনেক পূর্বেই শেষ হয়ে গেছে। বাইরে তার কথা শুনি নাই কিন্তু জেলের ভিতর তার নিষেধ না শুনে পারলাম না।


৬ জুলাই ১৯৬৬ বিকালে চা খাবার সময় সিকিউরিটি জমাদার সাহেবকে আসতে দেখে ভাবলাম বোধ হয় বেগম সাহেবা এসেছেন। গত তারিখে আসতে পারেন নাই অসুস্থতার জন্য। ‘চলিয়ে, বেগম সাহেবা আয়া।’ আমি কি আর দেরি করি? তাড়াতাড়ি পাঞ্জাবি পরেই হাঁটা দিলাম গেটের দিকে। রেণুকে জিজ্ঞাসা করলাম,  ‘খুব জ্বরে ভুগেছ। এখন কেমন আছ?’  ‘পায়ে এখনো ব্যথা। তবে জ্বর এখন ভালোই।’   বললাম, ‘ঠাণ্ডা লাগাইও না’।  আজ অনেক সময় কথা বললাম। সময় হয়ে গেছে, ‘যেতে দিতে হবে।’ বিদায় দিয়ে আমার স্থানে আমি ফিরে এলাম।  কখনো কখনো স্ত্রীর উপস্থিতি কামনায় আকুল হয়ে উঠতেন, অপেক্ষা করে থাকতেন, না এলে মুষড়ে পড়তেন কিছুক্ষণের জন্য—


২১ জুলাই ১৯৬৬ ভেবেছিলাম আজ রেণু ও ছেলে-মেয়েরা দেখতে আসবে আমাকে। হিসাবে পাওয়া যায় আর রেণুও গত তারিখে দেখা করার সময় বলেছিল, ‘২০ বা ২১ তারিখে আবার আসব।’ চারটা থেকে চেয়েছিলাম রাস্তার দিকে। মনে হতে ছিল এই বোধ হয় আসে খবর। যখন ৫টা বেজে গেল তখন ভাবলাম, না অনুমতি পায় নাই।  শেখ মুজিবের জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে, সকল রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে বেগম ফজিলাতুন নেছা ছিলেন অফুরান প্রেরণার উৎস। ১৯৬৬-তে ছয় দফা ঘোষণার পর থেকে শেখ মুজিব যখন বারবার জেলে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন তখন দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মীরা বেগম মুজিবের কাছে ছুটে আসতেন। তিনি তাঁদের বঙ্গবন্ধুর বিভিন্ন নির্দেশনা পৌঁছে দিতেন এবং লড়াই-সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার অনুপ্রেরণা জোগাতেন। জেলখানায় দেখা করার সময় ছেলে-মেয়েদের শিখিয়ে নিতেন একটু হৈচৈ করার জন্য, আর ওই ফাঁকে বাইরের সমস্ত রিপোর্ট স্বামীর কাছে দেওয়া আর তাঁর কাছ থেকে পরবর্তী করণীয় নির্দেশনা জেনে নেওয়া। নির্দেশনাগুলোর যথাযথ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা।



আমাদের বঙ্গমাতা ছিলেন জ্ঞানী, বুদ্ধিদীপ্ত, দায়িত্ববান এবং ধৈর্যশীল মানবিক মানুষ। জাতির পিতার 'অসমাপ্ত আত্মজীবনী' এবং 'কারাগারের রোজনামচা' লেখার মূল প্রেরণা ও উৎসাহ ছিল তাঁর জীবনসঙ্গী ফজিলাতুন্নেছার। শেখ মুজিবের ১২ বছর কারাবাস-কালে ছেলেমেয়েদের পিতৃস্নেহ দিয়েছেন বেগম মুজিব। শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনে প্রধান অবলম্বন ছিলেন তাঁর স্ত্রী। স্ত্রীকে তিনি গভীরভাবে ভালোবাসতেন। সর্বগুণে গুণান্বিতা ফজিলাতুন্নেছার সাহায্য ও সহযোগিতা না পেলে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে রাজনীতি করা সম্ভব হত না। বেগম মুজিব তাঁর জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সময় অত্যন্ত ধৈর্যের সাথে কাটিয়েছেন। ১৯৬৯ সালে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান শেখ মুজিবুর রহমানকে প্যারোলে মুক্তি দিয়ে লাহোরে বৈঠকে যোগদান করতে অনুমতি দিয়েছিল, তখন বেগম মুজিব তাঁর স্বামীকে এভাবে বৈঠকে যোগদান না করার পরামর্শ দেন। এবং বলেন- 'যদি বৈঠকে যোগ দিতেই হয়, তবে মুক্ত মানুষ হিসেবে বৈঠকে যোগ দেবেন।' কতটুকু আত্মবিশ্বাস ও বিচক্ষণতা থাকলে এ ধরনের পরামর্শ দেয়া যায় তা অনুভবের বিষয়। শেখ মুজিব ফজিলাতুন্নেছার কথা রেখেছিলেন। তিনি প্যারোলে মুক্তি নেননি। বঙ্গমাতা বুঝতে পেরেছিলেন এই গণআন্দোলনকে রুখে দেয়ার সাধ্য আয়ুব সরকারের নেই। মাওলানা ভাসানী, তোফায়েল আহমেদ, মতিয়া চৌধুরী, আনোয়ার হোসেন মঞ্জু সহ অনেকে তখন রাজপথ গরম করে রেখেছিলেন। এদের আন্দোলনে দ্রোহের আগুন জ্বলে উঠলো চারিদিকে। প্রবল গণআন্দোলনের মুখে ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করে নেয় এবং বঙ্গবন্ধুসহ সকল বন্দীদের নিঃশর্ত মুক্তি দিতে বাধ্য হয় আয়ুব সরকার। বঙ্গবন্ধুর এই নিঃশর্ত মুক্তির পেছনের কারিগর আমাদের বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা। ২৩ ফেব্রুয়ারি ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে বিশাল জনসভায় শেখ মুজিবুর রহমান এবং এই মামলায় অভিযুক্তদের গণসংবর্ধনা দেয়া হয়। এবং এই জনসভায় শেখ মুজিবুর রহমানকে বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত করা হয়।



বঙ্গবন্ধুর পক্ষে রাজনীতির দীর্ঘ পথ পাড়ি দেয়া সম্ভব ছিলো না, যদি না বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছার মত মানবিক নারীর সহযোগিতা না থাকতো। যতবার বঙ্গবন্ধু জেলে গেছেন, ততবারই তাঁর যোগ্য স্ত্রী কাপড়চোপড় গুছিয়ে দিতেন আর লেখালেখি করার জন্য সাথে দিতেন খাতা-কলম। বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনা 'কারাগারের রোজনামচা' গ্রন্থের শুরুতে ী ফজিলাতুন্নেছা প্রেরণা না দিলে আমরা বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে জানতেই পারতাম না।১৯৬৪ সালের আগস্ট মাসে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কের ৬৭৭ নম্বর বাড়ি নির্মাণের জন্য বঙ্গমাতা গৃহনির্মাণ সংস্থা থেকে ৩২ হাজার টাকা ঋণ গ্রহণ করেন। আমরা বেগম মুজিবকে এক দূরদর্শী নারীরূপে দেখি তাঁর সংসার যাত্রায়।১৯৭১ সালের ১ মার্চ থেকেই আন্দোলন-সংগ্রামে উত্তাল হয়ে উঠল সারাদেশ। ভুট্টোর প্রবল বিরোধিতার মুখে ঢাকায় নির্ধারিত ৩ মার্চের গণ পরিষদ অধিবেশনে ১ মার্চ ঘোষণার মাধ্যমে স্থগিত করে দেয়ায় বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠে বাংলার আপামর জনতা। ২ মার্চ হরতাল পালিত হয়। ৩ মার্চ পল্টনের জনসভায় লক্ষ লক্ষ জনতার সামনে অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিলেন বঙ্গবন্ধু। কর্মসূচির অংশ হিসেবে ৭ মার্চ রমনার রেসকোর্স ময়দানে ঐতিহাসিক জনসভার ঘোষণা দিলেন তিনি। ৭ মার্চ ভাষণে যাওয়ার আগেও বঙ্গবন্ধু বঙ্গমাতার পরামর্শ শুনেছিলেন। ঘর থেকে বের হবার আগে তাঁর স্বামিকে ডেকে নিয়েছিলেন, তাঁর সাথে কারা যাচ্ছেন তা জেনে প্রথমে বলেছিলেন জনসভায় যাওয়ার পথ পরিবর্তন করতে। পরামর্শ দিয়েছিলেন অন্য কারো পরামর্শ না নিয়ে নিজের বুদ্ধি আর বিবেক যা বলে তা বলার জন্য। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ লিখিত ছিল না। ঘর থেকে বের হওয়ার সময় বঙ্গবন্ধুকে ফজিলাতুন্নেছা স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন যে, 'তোমার পিছনে ইয়াহিয়ার বন্দুক এবং সামনে মুক্তিকামী মানুষের অগাধ বিশ্বাস আর ভালোবাসা।' ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের আত্ম জাগৃতির দীর্ঘ পথ বেয়ে স্বাধীনতা সংগ্রামের মহাকাব্য রচিত হলো। তাতে সর্বত্রই শেখ মুজিবুর রহমানের কথা কাহিনী বর্ণিত আছে। সেই মহাকাব্যে ক্ষুদ্র পরিসরে আছেন আমাদের বঙ্গমাতা। বঙ্গমাতার বিশালতা ও ব্যাপ্তি প্রতি পাতায় পাতায় হওয়া উচিত ছিল।১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে ও যুদ্ধকালীন তিনি তাঁর ডানার আড়ালে রেখেছেন সন্তানদের। তিনি নিজেকে সান্ত্বনা দিয়ে সন্তানদেরকে বলেছেন- ' কতবার কত দুর্দশায় পড়েছি, এবার না হয় একটু বেশি কষ্ট হবে।' চারিদিকে যুদ্ধ, যত্রতত্র হত্যা, ধ্বংসযজ্ঞ, এরমাঝে সমস্ত দেশের দায়িত্ব ছিলো বঙ্গবন্ধুর উপর। সে সময় বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সেনাপতিকে পেছন থেকে সাহস যুগিয়েছেন যিনি, তিনি আর কেউ নন, আমাদের বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং শেখ ফজিলাতুন্নেছা একে অপরের সাথে এত অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত যে, কাউকে আলাদা করা কোনভাবেই সম্ভব নয়। ফজিলাতুন্নেছা তিন বছর বয়স থেকে বঙ্গবন্ধুর সাথে মৃত্যু পর্যন্ত একে অপরের অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিলেন। তাঁরা পরস্পর পরস্পরের সৌরভে বিমোহিত ছিলেন। রেনুকে শেখ মুজিবের অলংকার মনে করা হলেও শুধুমাত্র শেখ মুজিবই জানতেন তাঁর জীবনীশক্তি আর প্রাণরস তিনি রেনুর থেকেই প্রতিনিয়ত পেয়ে রাজনীতির স্বর্ণশিখরে উঠেছিলেন।

পরিশেষে বলতে পারি, বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে যত বেশি আলোচনা হবে, বঙ্গমাতার অবদান তত বেশি উদ্ভাসিত হবে। বঙ্গমাতার বিশালত্বের অজানা নতুন নতুন দিক উন্মোচিত হবে। বাংলার রাজনীতির ইতিহাসে বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতার নাম চিরভাস্বর হয়ে থাকবে। বঙ্গমাতার জন্মদিনে গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি। 

তথ্যসূত্রঃ "আওয়ামী লীগের আত্মত্যাগী নেতাদের সংগ্রামী জীবন "  মোঃ মোফাজ্জেল হক।

No comments:

Post a Comment

Thank u very much