Saturday, August 14, 2021

গল্পঃ #হায়াত/পর্বঃ ৪/ সাহিল রহমান

হায়াত



পর্বঃ ৪ ও শেষ পর্ব


অগত্যা একটা ফোন পায় আসফাক, যেখানে তাকে বলা হয় স্ত্রী সুমির ভবিষ্যৎ মৃত্যুর কথা, কথাটা শুনে প্রথমে মাথা গরম হয়ে গেলেও ফোনকারী ব্যাক্তির অকাট্য কিছু প্রমাণে চুপ মেরে যায় আসফাক। সুমি সম্পর্কে অপ্রীতিকর এই ভবিষ্যৎ বানী শেষে, আসফাককে নির্দেশনা দেয়া হয় সময় ভ্রমণ সূত্রের, যেই সূত্র স্বয়ং আসফাক নিজেই তৈরি করেছে, আর এই সূত্র নিয়ে ছুটে এসেছে সুদূর ভবিষ্যৎ হতে। 


সেদিন সেই ফোনের পর আসফাকের জীবন পুরোপুরি অন্যরকম হয়ে যায়, ফোনের নির্দেশনা অনুযায়ী প্রথমেই আসফাক চলে যায় শহরের বাইরে পাইকপাল নামক একটি গ্রামে, যেখান হতে খুঁজে নেয় ভবিষ্যৎ হতে রেখে যাওয়া সময় ভ্রমণের সূত্র!


তার পরের নির্দেশনা অনুযায়ী আসফাক অপেক্ষা করতে থাকে একটি নির্দিষ্ট দিনের , ফোনের বর্ণিত বর্ণনা অনুযায়ী আসফাক একটি ট্যালি খাতা তৈরি করে, যেখানে প্রতিবার সময় ভ্রমণের পূর্বে টুকে রাখতে হবে সুমির অবস্থান, সময় ভ্রমণের সংখ্যা আর সুমির মৃত্যুর কারণ… 


কয়েক মাসের মধ্যেই চলে আসে সেই দিনটি, সেদিন ফোনের ভবিষ্যৎ বানী অনুযায়ী আসফাকের সামনেই মৃত্যু হয় সুমির। সেই সাথে আসফাক শুরু করে এমন এক যাত্রা যার শেষ কোথায় সেটা কেউই জানে না, এমনকি আসফাক নিজেও না…  


~


কেন যেন আজকাল আসফাকের কাজগুলো খুব সন্দেহ লাগে সুমির, সুমির আজকাল মনে হয় আসফাক ওকে ধোঁকা দিচ্ছে, আসফাকের কাছে সুমির প্রয়োজন শেষ, ওলট-পালট সব কল্পনা চোখের সামনে হুট করে প্রায়ই ভেসে ওঠে সুমির। 

আসফাক সুমিকে তার বাবার বাড়িতে যেতে দিচ্ছে না ! আবার মাঝে মাঝে দেখা যায় সুমিকে মিথ্যা বলে আসফাক বাবার বাড়িতে ফেলে এসেছে! 


এমন হাজারো কল্পনা অহরহ চোখের সামনে ভাসলেও সুমি এটা বুঝতে পারে আসফাক সত্যি অনেক পরিবর্তিত হয়ে গেছে, সে আগেও ব্যস্ত ছিল কিন্তু এখন তার কাজের ধরন, কাজের ব্যস্ততা, অস্থিরতা সব কিছুই কেমন অন্য রকম মনে হয়। আজকাল বড্ড একা লাগে সুমির নিজেকে, সব থেকে বড় ব্যাপার ভালবেসে বিয়ে করা আসফাক নামের মানুষটাকে ভয় হয় ভীষণ…


~


ট্যালি খাতার উপর হেলান দিয়ে বসে আছে আসফাক, আসফাকের জন্য এখন অতীত বর্তমান ভবিষ্যৎ যেন একটি জায়গায় আটকে গেছে, তাই মাঝে মাঝে ট্যালি খাতায় চোখ বুলিয়ে নিজের সময়ের অবস্থান ঠিক করে নেয় সে। চোখ বোলাতে বোলাতে বিগত দিনের সময় ভ্রমণের নম্বরটা দেখে চোখ কপালে উঠে গেল তার, যার শেষ কলামে লেখা- 


সময় ভ্রমণ নম্বর ৬৯৯, 

সুমির অবস্থান বান্দরবন, 

মৃত্যুর কারণ - পাহাড় ধ্বস, 


সংখ্যাটা দেখে এক চাপা কষ্টের নিঃশ্বাস ত্যাগ করল আসফাক, প্রায় দুই বছর হতে চলেছে, শেষবারের সময় ভ্রমণ সহ ৬৯৯-তম ভ্রমণ করা হয়ে গেছে ইতিমধ্যে, কিন্তু প্রতিবারেই কোন না কোন ভাবে মৃত্যু হয়েছে সুমির, কোথায় গেলে কি করলে অতীতের এই পরিণতি পরিবর্তন হবে কে জানে!


আসফাক তার ট্যালি খাতার নিচে নতুন করে নম্বর তুলল, 

সময় ভ্রমণ নম্বর ৭০০, তারপর টাইম মেশিনে উঠে বসে অতীতের এক সময় চলে গেল যেখানে সুমি গতকাল অব্দি জীবিত ছিল। 


~


সকাল বেলা উঠেই বের হয়ে পড়ল আসফাক, ইতিমধ্যে ভবিষ্যৎ হতে ফোন পেয়ে গেছে সে, বোঝা যাচ্ছে গত বারের অভিযান ব্যর্থ, ঢাকার বাইরে সুমিকে নিয়ে যাবার প্লানগুলো কাজে লাগেনি। 

আসফাকের আজকের প্লান ভিন্ন, সুমিকে এবার ঘরেই রেখে দেবে আসফাক, সন্ধ্যার আগে এসে বাইরে থেকে গ্যাসের লাইন, ইলেকট্রিক লাইন কেটে দেবে, ঘরের মধ্যে থেকে যেন সুমির কোন ধরনের বিপদ বা দুর্ঘটনা ঘটতে না পারে এই সকল লাইনগুলি বিছিন্ন করে দেবে সে।  


পরিকল্পনা অনুযায়ী আসফাক সকাল সকাল বের হয়ে গেল, আসতে দেড়ি হবে এই কথাটাও বলে গেল সুমিকে।


~


বিকেল হতেই  অস্থির লাগতে লাগল আসফাকের, এই নিয়ে সুমিকে সে কত বার মরতে দেখছে তার ঠিক নেই, কিন্তু হাল ছাড়বে না আসফাক যত কিছুই হয়ে যাক না কেন। হাত ঘড়িতে সময়টা দেখে নিয়ে বাড়ির দিকে রওনা করল আসফাক। 


বাড়িতে পৌঁছেই বাইরে থেকে গ্যাস, ইলেকট্রিক সহ অন্যান্য সংযোগ বিছিন্ন করে দিল, তারপর ধীরে ধীরে সিঁড়ি দিয়ে নিজ ফ্ল্যাটের দিকে অগ্রসর হতে লাগল। আজ কি হবে সুমির সাথে সেটা দেখতে না চাইলেও বাধ্য হয়ে দেখতে হবে আসফাককে। চিন্তাটা মাথা হতে ঝেড়ে ফেলে দ্রুত সিঁড়ির দিয়ে পা চালাল আসফাক… 


বাড়ির দরজার সামনে এসে কলিং বেল চাপল আসফাক, কলিং বেল বাজল না, নিজেই মনে করে নিল বিদ্যুতের লাইন কাটা ! পকেট হতে চাবি বের করে গেট খুলল আসফাক, কেন জানি বুক ধুঁকধুঁক করে কাঁপছে তার। এই সময়টাতে সর্বদা বুকের মধ্যে ভয় কাজ করে আসফাকের। 


ধীরে ধীরে নিজেদের ঘরে প্রবেশ করল আসফাক, সুমি কি করছে কে জানে? ঘরের দরজার সামনে যেতেই সুমিকে দেখে মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠল আসফাকের। 

না ! সুমি এখনো জীবিত আছে, বিছানায় অন্য একটি ছেলের সাথে প্রেম খেলায় মশগুল হয়ে আছে সুমি, এতটাই মসগুল যে আশেপাশে কি হচ্ছে কোন কিছুরই খোঁজ নেই তার ! 


আসফাক তার শরীরের সমস্ত শক্তি যেন হারিয়ে ফেলছে, যেই স্ত্রীকে বাঁচাতে দীর্ঘ দুই বছরের বেশী সময় নিজের জীবনটা তছনছ করে ফেলেছে আসফাক আজ সে কিনা এভাবে ধোঁকা দিচ্ছে তাকে? রান্না ঘরে গিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল আসফাক, তারপর ধুপ করে বসে পড়ল মাটিতে। 


~


আসফাকের অদ্ভুত চাল চলনে অস্থির হয়ে উঠেছিল সুমির জীবন, আসফাকের কাছ থেকে মুক্তি পেলে যেন সে বাঁচে, কিন্তু আসফাক সুমিকে এত সহজে ছেড়ে দেবে না সেটাও সুমি জানত। আর এই দোটানা থেকেই হুট করে একটি ছেলের সাথে অজান্তেই সুমি জরিয়ে পড়ে পরকীয়ায়। সুমি জানত সুমির এটা করা ঠিক না কিন্তু কেন যেন নিজেকে আটকাতে পারছিল না সে। আর অল্প সময়ের মধ্যে সুমির এই প্রেমের সম্পর্কটা অনেকটা গভীরে চলে যায়। সুমির ধারণা ছিল সুমির এই সম্পর্কের কথা আসফাক কোনদিনও জানতে পারবে না, আর আজ আসফাক দেড়ি করে আসবে সেটা বলেই গিয়েছিল, তাই প্রেমিককে নিজ বাড়িতেই ডেকে এনেছে সুমি। 


রান্না ঘর হতে হঠাৎ ধুপ একটি শব্দ শুনে হুশ আসল সুমির, সুমি বেড রুম হতে সামান্য গলা ছেড়ে বলল ‘কে?” সুমিকে জড়িয়ে রাখা প্রেমিক বলল বিড়াল-টিরাল হবে হয়ত। এক বার ভাবল সুমি, আসফাক এমনিতেই  অনেক রাত করে বাড়ি ফেরে, আর আজ সে বলেই গেছে দেড়ি হবে, সুতরাং আসফাকের আসার কোন প্রশ্নই নাই। আর আসফাক এসে নিশ্চয়ই রান্না ঘরে ঢুকবে না, বেল বাজাবে প্রথমে… 


তবুও সুমির মনে খটকা রয়ে গেল, “একটু দেখে আসি” প্রেমিককে এই কথা বলে গায়ে চাদরটা জড়িয়ে বিছানা হতে উঠে সোজা রান্না ঘরের দিকে পা বাড়াল সুমি, কাছাকাছি এসে আবার ডাক ছাড়ল “কে?” 


~


সুমির কণ্ঠ কানে আসল আসফাকের, বুঝতে পারল এদিকে এগিয়ে আসছে সুমি, উঠে দাঁড়াল আসফাক, রান্না ঘরের কেবিনেট হতে মাঝারি ধারাল ছুরিটা হাতে তুলে নিল সে, তারপর শক্ত হয়ে দাড়িয়ে রইল দরজার আড়ালে। সুমি রান্না ঘরে ঢুকেই ভেতরে তাকাল, একটু এগিয়ে নিচু হয়ে দেখল বিড়াল ঢুকেছে কিনা? নাহ কেউ নেই, হাফ ছাড়াল সুমি। তারপর বের হবার জন্য পেছনে ঘুরতেই হতভম্ব হয়ে গেল সে, শরীরের শক্তি মুহূর্তেই হারিয়ে গেল তার। সুমি দেখল ধারাল ছুরি হাতে আসফাক দরজার সামনে দাড়িয়ে আছে !  


সুমি কিছু বলার আগেই তার পেটে ছুরি বসিয়ে দিল আসফাক, একটা চিৎকার করে উঠল সুমি, কিন্তু এই চিৎকারে কোন লাভ হল না বোধহয়, হাতের ছুরিটা আরও শক্তি করে সুমির পেটে ঠেলে দিল আসফাক। 


সুমির চিৎকারে হুড়মুড় করে সুমির ঘর হতে বের হয়ে এল তার প্রেমিক, সুমিকে আর আসফাককে দেখে কলিজা মুহূর্তেই উড়ে গেল তার, নিজের জান নিয়ে পালাল তৎক্ষণাৎ…


~


অল্প সময়ের মধ্যে পুলিশ আসল আসফাকের বাসায়, সুমির দেহটাকে তার গায়ের চাদর দিয়েই ঢেকে রাখল আসফাক, সমস্ত মেঝে জুড়ে রক্তের বন্যা, আসফাকের হাত জামা সুমির রক্তে লাল হয়ে গেছে। সুমির লাশের পাশ হতেই পুলিশ আসফাককে উদ্ধার করল, খুনের ছুরিটা তখনো সুমির শরীরে বিঁধে আছে। 


~


চারপাশে মানুষের ভিড়, পুলিশের সাইরেন আর এম্বুলেন্সের বাতি জ্বলছে আর নিভছে। সুমির লাশ এম্বুলেন্সে তোলা হল, তারপর আসফাককে উঠানো হল অন্য একটি গাড়িতে, কিছুক্ষণের মধ্যেই ওদের নিয়ে রওনা রওনা হল পুলিশ, রাস্তায় মানুষের ভিড়ে গাড়ি অল্প দূরে গিয়ে দাড়িয়ে পড়ল জ্যামে! 


পাশের মসজিদ ওয়াজ চলছে, অনেক লোক জড়ো হয়েছে এখানে, তাই এত ভিড়। মসজিদের মাইকে বক্তার একটি কথা কানে আসল আসফাকের, আসফাকের মনে হল এই কণ্ঠের এই কথাগুলো আসফাক আগেও একবার শুনেছে… 


কথাগুলো আসফাক কোথায় শুনেছিল সেটা সে মনে করতে পারল না, হয়ত কোন এক সময় ভ্রমণে, মনে করার চেষ্টাটা বাদ দিল আসফাক, তারপর বিড়বিড় করে বলল, “আর না…”

নিজের তৈরি সময় ভ্রমণ যন্ত্রের কথা একবার মন হল তার, কিন্তু সেটা নিয়েও চিন্তা বাদ দিল আসফাক, পাইকপাল গ্রামে আসফাকের তৈরি এই যন্ত্র যেখানে লুকানো আছে সেটা কেউ কোনদিন খুঁজেও পাবে না। যদি গ্রামের লোকেদের কেউ কোনদিন খুঁজেও পায়, এটাকে একটা আস্তকুর ভেবে ফেলে দেবে ভাঙ্গারিতে।


~


অশ্রু সিক্ত নজরে বাইরে তাকাল আসফাক, মসজিদের বক্তার কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনতে লাগল সে, তারপর বিড়বিড় করে বক্তার সেই কথাগুলো পুনরাবৃত্তি করতে লাগল বর্তমান সময়ের নামকরা বিজ্ঞানী আসফাক, যে কিনা তৈরি করেছিল সময় ভ্রমণের সূত্র…


অনেকটা পথ চলে আসার পর আসফাকের গাড়ির চালক আর সেখানে উপস্থিত পুলিশ লক্ষ্য করল, কিছুক্ষণ আগে খুনের স্পট হতে তুলে নিয়ে আসা মানুষটা পেছেন হতে বিড়বিড় করে করে বারবার একটি বাক্য বলে চলেছে, 


“মানুষের হায়াত নির্ধারিত, রিজিকে যা লেখা যা আছে তার বেশী একটা ভাতও সে খেতে পারবে না!” 


লোকটাকে পাগল মনে হল ওদের কাছে… 


“সমাপ্ত”


লেখকঃ Sahel Rahman



No comments:

Post a Comment

Thank u very much