Saturday, August 14, 2021

গল্পঃ #হায়াত/পর্বঃ ৩/ সাহিল রহমান

হায়াত



পর্বঃ ৩


সুমিকে বাঁচানো সম্ভব হয়নি ! 

বার্ন ইউনিটের ওটিতে ডাক্তার যখন সুমিকে নিয়ে যায় তার অনেক আগেই আসফাক এটা আন্দাজ করতে পেরেছিল যে সুমি বাঁচবে না। আর তাই এটা নিয়ে আসফাক না করল কোন চিন্তা আর না করল কোন আফসোস। আসফাকের সম্পূর্ণ চিন্তার গতি ঘুরে গেল ভিন্ন এক দিকে, আর তা হল, দুই বার সময় ভ্রমণ করেও কেন আসফাক সুমিকে বাঁচাতে পারল না? কি হতে পারে এর কারণ? হাসপাতালে সুমির ওটি থেকে অনেকটা দূরে একটা বেঞ্চের উপর বসে বেশ অনেকটা সময় ধরে এই বিষয়টা নিয়েই ভাবতে থাকল আসফাক…  


তারপর নিজে হতে একটি উত্তরে উপনীত হল সে, দুই বার সময় ভ্রমণ করে সুমিকে বাঁচাতে ব্যর্থ হবার একটাই কারণ হতে পারে, আর তা হল আসফাকের এই দুই বারের চেষ্টায় সুমির জন্য নির্ধারিত মৃত্যু পরিবর্তন হয়নি!  কোয়ান্টাম মেকানিক্সে সময়ের সাথে দুটি বিষয়ের সূক্ষ্ম সম্পর্ক রয়েছে, আর সেগুলো হল অবস্থান আর পরিণতি! 


কোন একটি নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট অবস্থানে মানুষের পরিণতি নির্দিষ্ট হয়ে থাকে, সময় আর অবস্থানের সাথে এই পরিণতির পরিবর্তন হতে পারে। কিন্তু অতীতে এই সময়ে এসে আসফাক সুমির অবস্থান পরিবর্তন করছে ঠিকই কিন্তু পরিণতি এখানে অপরিবর্তিত রয়ে গেছে! 


যার অর্থ আসফাককে সুমির জন্য এমন একটি অবস্থান খুঁজে বের করতে হবে যেখানে ওই নির্দিষ্ট সময়ের সাথে সাথে সুমির পরিণতি পরিবর্তিত হয়ে যাবে। আর এই জন্য আসফাককে বারবার ২৭ বছর করে সময় নষ্ট করলে চলবে না ! 

সুমির এই পরিণতির পরিবর্তিত করার জন্য তার সেই অবস্থান বের করতে হলে আসফাককে একের পর এক সময় ভ্রমণ করতে হবে, আর খুঁজতে হবে সেই অবস্থান যেখানে পরিবর্তন হয়ে যাবে এই অতীত!


হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের কাছাকাছি বসে থাকা বেঞ্চ হতে ধীরে উঠে দাঁড়াল আসফাক, একনজর সুমির ওটির দিকে তাকাল সে।  লক্ষ্য করল সুমির বাবা, আত্মীয় স্বজনরা প্রায় সকলেই হাজির হয়েছে এখানে, সবার চোখে পানি আর মুখে কান্নার আওয়াজ। যেন কেউই মানতে পারছে না বিষয়টি। 


সুমির সব আপনজন কাঁদলেও তাদের মধ্য হতে শুধু আসফাক মোটেও কাঁদল না, ধীর পায়ে একটি শব্দ না করে বের হয়ে গেল হাসপাতাল হতে। সুমির সকল আত্মীয় সুমির এই দুর্ঘটনা মেনে নিতে না পারলেও দিন শেষে মেনে নিত, কারণ এটা মেনে নিতে হয়, কিন্তু আসফাক সত্যি সত্যি ঘটনাটাকে মেনে নিতে পারল না। 


কিছুদিন পর কাউকে কিছু না জানিয়ে সমাজ আর সকল আত্মীয় স্বজন হতে একদম হারিয়ে গেল আসফাক, সে কোথায় গেছে সেটা জানল না কেউই…


~


এই নিয়ে তৃতীয় বারের মতন পুনরায় ২৭ টি বছর পার করল আসফাক, এবার আসফাকের মস্তিষ্কে একত্রে বিছিন্ন কিছু ঘটনার প্রতিফলন অনুভব করল সে। সুমির গাড়ি দুর্ঘটনা, সিলিং ফ্যান মাথায় পড়ে যাওয়া আর রান্না ঘরে সিলিন্ডারে আগুন লেগে যাওয়া, এই তিনটি ঘটনাই যেন আসফাক একত্রে দেখতে পায়। 


দীর্ঘ ২৭ বছর পার করে নিজের সময় যন্ত্র তৈরি করার পর আসফাক এটাও উপলব্ধি করল যে একই সময় আসফাক যেন সুমিকে দুই ভাবে আগুনে পুড়ে যেতে দেখছে, এই অনুভূতিটা খুবই অদ্ভুত। আসফাকের মনে হয় আসফাক যখন সুমিকে নিয়ে হাসপাতালে যাচ্ছিল ঠিক তখনই সেই একই সময়ে সে দূরে দাড়িয়ে এই ঘটনাটাকে পর্যবেক্ষণ করেছিল! 


কেন এমন অনুভূতি সেটা আসফাক ভাল করেই জানে, কারণ সেদিন আসফাককে যেই মানুষটা ফোন করেছিল সে ছিল আসফাক নিজেই, আর সে দূরে দাড়িয়ে দেখছিল সব কিছু। 


~


আসফাকের টাইম মেশিন তৈরি, কিন্তু এবার আসফাক আগের দুই বারের মতন এই যন্ত্রে উঠে বসল না, সে ঠাণ্ডা মাথায় অপেক্ষা করতে থাকল আর করতে চিন্তা করতে থাকল। আসফাক এবার অতীতের সেই একই দিনে ফিরে যাবে না, এবার সময় ভ্রমণ করার আগে খুব ভাল করে পরিকল্পনা করতে হবে আসফাককে। 


এবার আসফাক ফিরে অন্য একটি সময়ে, যেটা হবে সুমির মৃত্যুর বেশ কিছুদিন আগের!


~


সুমির মৃত্যুর বেশ কিছুদিন আগে গিয়ে আসফাক আগত ভবিষ্যৎ সম্পর্কে অতীতের আসফাককে অবগত করবে, আসফাক জানে এবারও হয়ত সুমিকে বাঁচানো যাবে না, কিন্তু চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে এক এক করে। এই চেষ্টার মাধ্যমে বের করে আনতে হবে এমন একটি অবস্থান যেই অবস্থানে সুমির পরিণতি পরিবর্তন হবে, আর তখনই মৃত্যু থেকে বাঁচানো যাবে সুমিকে। 


সুমির মৃত্যুর সম্পর্কে অতীতের আসফাককে অবগত করার পরেই তার হাতে তুলে দিতে হবে সময় ভ্রমণের সূত্র, জানিয়ে দিতে হবে পাইকপালে আসফাকের এই ল্যাবের খোঁজ। এভাবে বারবার ২৭ বছর করে সময় নষ্ট করা সম্ভব নয়, সময় ভ্রমণের সূত্র ২৭ বছর আগেই দিয়ে আসতে হবে আসফাককে, যেন আসফাক সুমির মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে পুনরায় অতীতে চলে যেতে পারে। 


~


সময় ভ্রমণ যন্ত্র তৈরির পরে প্রায় মাস খানেক ধরে সমস্ত পরিকল্পনা করল আসফাক, তারপর নিজের তৈরি এই পরিকল্পনা অনুযায়ী টাইম মেশিনের মধ্যে দিয়ে রওনা করল অতীতে… 


~


কোয়ান্টাম মেকানিক্স নিয়ে একটা বড় কনফারেন্সে বিশেষ বক্তা হিসেবে আমন্ত্রণ করা হয়েছে তরুণ সায়েন্টিস্ট আসফাককে, দেশের ভেতর ও বাইরের অনেক বিজ্ঞানী উপস্থিত আছেন এই সভায়। এছাড়াও উপস্থিত আছেন দেশের বিভিন্ন ভার্সিটির শিক্ষার্থীরা। এক এক করে বিভিন্ন বিজ্ঞানী নিজেদের ভবিষ্যৎ প্রোজেক্ট, বর্তমান গবেষণা ও বিভিন্ন ধরনের মতবাদ ও মতবেদ নিয়ে নিজেদের বক্তব্য পেশ করল সকলের সামনে। বিজ্ঞানীদের জন্য বেশ উৎসব আর উৎসুক পরিবেশ তৈরি হল সুবিশাল এই হল রুমটার মধ্যে। 


অন্যান্য সবার ব্যক্তিতা শেষে, আসফাককে স্টেজে আমন্ত্রণ করলেন এই কনফারেন্সের প্রধান অথিতি, হাসি মুখে স্টেজে উঠে এল আসফাক, তারপর নিজের বক্তব্য পেশ করল সকলের সামনে। আসফাকের ভীষণ  তথ্যবহুল আর কৌতূহলী বক্তিতায় সভায় উপস্থিত সকলের করতালিতে মুখরিত হল হল ঘর। আনন্দের সাথে চারপাশে এক নজর তাকাল আসফাক, মনের মধ্যে আনন্দের ঢেউ অনুভব করল সে। কিন্তু হঠাৎ আসফাক লক্ষ্য করল পেছনের দিকের সারিতে কেউ একজন হাত উঁচু করে বসে আছে, ছেলেটার ভাবভঙ্গি দেখে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে কোন প্রশ্ন আছে তার, কিছু জানতে চায় সে!


ছেলেটিকে দেখে মনে মনে খুশী হল আসফাক, এমন কৌতূহলী মানুষ পছন্দ তার, আসফাক অরগানাইজারদের মধ্যে একজনকে উদ্দেশ্যে করে ওই ছেলেটিকে মাইক দেবার জন্য ইশারা করল, একজন হেটে গিয়ে ছেলেটার হাতে মাইক দিলে, উঠে দাঁড়াল ছেলেটি! 


শুকনো, হ্যাংলা পাতলা গড়নের একটি ছেলে, সাদা টি-শার্ট পরিহিত, বোঝাই যাচ্ছে কোন ভার্সিটির শিক্ষার্থী। আসফাক চোখের ইশারায় ছেলেটিকে তার প্রশ্ন করতে বলল, ছেলেটি সামান্য অপ্রস্তুত হয়ে অল্প সময় অপেক্ষা করেই প্রশ্নটা করে ফেলল, “স্যার সময় ভ্রমণ কি আসলেই সম্ভব? আপনি কি মনে করেন এই বিষয়ে?”


ছেলেটির প্রশ্ন শুনে একই সাথে অবাক আর বেশ বিরক্ত হল আসফাক, আজকের কনফারেন্সের বিষয়ের সঙ্গে সময় ভ্রমণ টপিক কোন ভাবেই জড়িত না, আর তার থেকেও বড় কথা সময় ভ্রমণ একটি বিজ্ঞানিক ফিকশন, আজকের মতন এমন একটি কনফারেন্সে এই ধরনের অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্ন করা মোটেও সমীচীন নয়। নিজেকে শান্ত রেখে ছেলেটির প্রশ্নের উত্তর দিল আসফাক, 

“বিজ্ঞান সর্বদা যুক্তিতে চলে, সেখানে আমার মনে করা দিয়ে কিছু যায় আসে না, আজ পর্যন্ত জোগাড়কৃত সকল তথ্য আর উপাত্ত অনুযায়ী সময় ভ্রমণ এখনো একটি অবাস্তব বিষয়, এটি বিজ্ঞানিক ফিকশন ছাড়া আর কিছুই না !” 


কথাটা শেষ করে স্টেজ হতে নেমে গেল আসফাক, ওয়াশ রুমের দিকে এগিয়ে যেতে লাগল সে, দুপুরে বেশ বড় লাঞ্চের আয়োজন করা হয়েছে এখানে, তার আগে একটু হাত মুখ ধোঁয়া দরকার। ততক্ষণ পর্যন্ত আসফাক জানত না যে কিছুক্ষণের মধ্যেই সময় ভ্রমণের একটি অকাট্য প্রমান পেতে চলেছে সে…


ওয়াশ রুমের দরজার কাছাকাছি যেতেই মোবাইলটা বেজে উঠল আসফাকের, অপরিচিত একটি নম্বর, এক হাতে ফোনটা ধরে হ্যালো বলে অন্য হাত দিয়ে ওয়াশ রুমের দরজার হাতলে মোচড় দিল আসফাক, ফোনের ওপাশ হতে একটি কণ্ঠ ভেসে আসল আসফাকের কানে, যেই কণ্ঠটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে চোখ কপালে উঠে গেল তার! 

“চলবে”




লেখকঃ Sahel Rahman



No comments:

Post a Comment

Thank u very much