এক জোড়া চোখ
এম ডি মনির
ব্যাপারটা এত দ্রুত ও রহস্যজনকভাবে ঘটে যাবে আমি শুধু চিন্তা করিনি তাইই না, পুরো বিষয়টি যেমন নাটকীয় তেমন অকল্পনীয়ও। নাটকীয় বা সিনেমেটিক যাই বলি না কেন আমার কাছে মনে হচ্ছে যে কোন উপমায় কম হয়ে যাচ্ছে।
মাসখানেক আগের ঘটনা। আমি ঢাকা থেকে শ্যামলী পরিবহনে বাড়ি ফিরছিলাম।
জার্নি করার ক্ষেত্রে আমি সব সময়ই দিনের আলো বেছে নিই। অবশ্য কারণ একটাই জানালায় মুখ রেখে এ বাংলার সবুজ শ্যামল মাঠ ঘাট নদী আর মায়াময় গ্রাম গুলো দেখতে দেখতে গাড়ি ভাড়ার পয়সা উশুল করা। চিন্তা করে দেখুন মেহেরপুর টু ঢাকা পাঁচশ টাকা ভাড়া। আপনি রাতের আঁধারে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে বাড়ি ফিরলেন। আর আমি সেই একই ভাড়ায় দিনের আলোয় নদী দেখছি ব্রীজ দেখছি৷ কতশত মানুষের মুখ। খেটে খাওয়া মুখ। দুঃখী মুখ।
স্কুল ড্রেস পরা কিশোর কিশোরীদের অকারণে হেসে হেসে হেটে যাওয়া। সবুজে সবুজে ছেয়ে থাকা গ্রাম ----
আহা!
আমি এই লোভ কিছুতেই সামলাতে পারিনা।
যাইহোক ধান ভানতে শিবের গীত গেয়ে ফেললাম।
আমি শ্যামলী পরিবহনে বাড়ি ফিরছিলাম। সকাল নয়টায় গাড়ি ছেড়েছে। দুপুর নাগাদ ঝুম বৃষ্টি এলো। জানালার কাঁচে মুখ লাগিয়ে আমি বৃষ্টি দেখছি আর মনে মনে কত কথা যে ভাবছি তার হিসাব নেই।
কুষ্টিয়া পর্যন্ত আসতে আসতে বিকেল হয়ে গেলো। মহাসড়কে একটা এক্সিডেন্ট হয়ে রাস্তা ব্লক। ড্রাইভার হটাৎ ডানে মোড় ঘুরে গাড়ি গলি রাস্তায় ঢুকিয়ে দিলো। এই গলি রাস্তা দিয়ে খানিকটা গেলেই আবার মহাসড়কে ওঠা যাবে।
বৃষ্টি থেমে গেছে। গলি রাস্তায় খুব ধিরে ধিরে গাড়ি চলছে। আমি জানালা খুলে দিয়ে চুপচাপ বাড়ি ঘর দেখছি। হঠাৎ গাড়ির ব্রেক। সরু রাস্তায় দ্বিমুখী যানবাহন যাওয়া সম্ভব না। সামনে থেকে গাড়ি আসায় ব্রেক করেছে। ঠিক তখনই ঘটে গেলো জীবনের সেরা মুহূর্তটা। রাস্তা লাগোয়া একটা বাড়ি। আমার জানালা সোজাসুজি আরেকটা জানালায় এক জোড়া চোখ! ধবধবে সাদা মুখের উপর এক জোড়া চোখ!
চোখ নয় যেন সাগর!
আমি হঠাৎ কোন সাগরে পড়ে গেছি। আমি সাগরে সাঁতার কাটছি।
তল নেই কুল নেই
অথৈজলে ভাসছি যেন।
মেয়েটা মুখ সরিয়ে নিতে পারতো। চোখ নামিয়ে নিতে পারতো।
কিছুই করলো না। কার ইশারায় কে জানে সেও তাকিয়ে আছে আমার চোখে।
দুজনেই পলকহীন
দুজনেই ভাবলেশহীন
কেমন বোকার মতো ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছি দুজনে।
যে কোন সময় গাড়ি টান দিতে পারে।
কি করা উচিৎ আর কি বলা উচিৎ কিছুই ভাবতে পারছি না।
বুকের ভিতর মোচড় দিচ্ছে।
কেন জানি চোখে পানি চলে আসছে.। কেন আসছে?
মনে হচ্ছে শত সহস্র বছরের চেনা কোন নারী। এতদিন শুধু আমি আসবো বলে অনন্তকাল জানালার শিক ধরে অপেক্ষা করছিল। আমরা অনেক দিনের পরিচিত। অনেক দিন অনেক বছর পর আমাদের দেখা। এত বছর পর দেখা হয়ে আমরা খুশিতে বাকরূদ্ধ হয়ে গেছি যেন।
জানালাটা এতই কাছাকাছি ছিল যে ইচ্ছে করলেই ছুঁয়ে দেওয়া যেত৷
পকেটে আনকোরা নতুন একটা একশো টাকার নোট ছিল।
টাকাটা বের করে দ্রুত আমার মোবাইল নাম্বার লিখে ফেললাম।
ও চোখে তাকিয়ে বললাম
সার্চলাইটের মতো জ্বেলে
এক জোড়া চোখ
জানালার গ্রীলে রেখে হাত
আবার দেখা হোক
পুড়ে যদি যায় যাক বুকের ভিতর
তবুও তো পুড়বে কিছু শোক।
এক জোড়া চোখ
আবার দেখা হোক।।
আমার মুখে কবিতা আবৃত্তির মতো কথা গুলো শুনে অবাক বিষ্ময়ে চোখ আরো বড় বড় করে হাত দিয়ে মুখ ঢাকলো। তখনো আংগুলের ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে এক জোড়া চোখ।
গাড়ি ছেড়ে দিলো। আমি টাকা টা জানালা দিয়ে মেয়েটির রুমে ছুড়ে দিলাম।
দেখলাম মেয়েটি খুশিতে লজ্জায় লাল হয়ে গেলো। কিছু একটা বলতে গিয়েও থেমে গেলো---
পড়ন্ত বিকেল। একটু আগেই থেমেছে বৃষ্টি। স্নিগ্ধ শান্তির হাওয়া বয়ে বয়ে যাচ্ছে।
আমি চোখ বুজে ভাবছি
এক জোড়া চোখ
আবার দেখা হোক ---
No comments:
Post a Comment
Thank u very much