Wednesday, July 14, 2021

কামরান চৌধুরী'র লেখা কবিতা ”কাজল আঁখি”


     

কাজল আঁখি        

কামরান চৌধুরী

      

কবি, কাব্য কতক্ষণে শেষ হবে, রেখে দাও কাগজ কলম
কচিকচি ঘাস ডাকে, চলো হাঁটি কিছুটা সময়, কচ্ছপ গতিতে।
কণ্ঠে আকুলতা শুনে কবি পাশ ফিরে দেখে  
কালোকেশে কবরী বন্ধনে কাজল চোখে কুঞ্জলের মতো চেয়ে
কাছে পাবার কাঙ্খা, কত কথা জমে আছে কনকলতার বুকে।

কপোত-কপোতী কার্ণিশে মিলন আকাঙ্খায় কাছাকাছি,
কালক্ষয় করো নাতো, কাছে এসো কবি।
কৃষ্ণপক্ষ রাতে কোলে শুয়ে শুয়ে কামনা ছড়ায় 
কানে কানে কথা বলে, কামিনী সুগন্ধ ছড়ায়। 
কটিদেশে কারুকার্যময় বন্ধনী, কপালে কমনীয় বাসনা;
কম্পিত কণ্ঠে কলধ্বনি, কল্পিত মধুর সে প্রেম কাহিনি। 

কালক্ষয় করো না কবি, কাজ রেখে কাঁকন পরা হাত ধরো। 
কালান্তর কালবৈশাখী আসছে ধেয়ে, কালোমেঘে ঢেকে কিংবদন্তি হতে
কিঞ্চিৎ সময় ধার দাও কিশলয় দেখার, বুকের উষ্ণতা নেবার।
কৃষাণ-কৃষাণির কুটির মাঝে দিনময় কতকত কাজ
কৌতুহলে দেখি, কষ্টেকষ্টে কাটা কতো সুখ-কান্না,
কৎবেল গাছে কুটুমপাখি ডাকে। 
কুহক কুহেলি সরে যায়, কূজন বাড়ে, 
কৃপাদৃষ্টি দাও না কবি, কৃতার্থ কর মন, কুসুমাঞ্জলি নাও।

কেউ না জানুক, আমিই জানি, বুকের কোণে কার প্রতিকৃতি আঁকো 
কবিতা গানে সখা আজো, আমার কোমল পরশ মাখো।।

২০.০৭.২০১৭ ।। শ্যামলী, ঢাকা।

Monday, July 12, 2021

আর. এ. খাঁন রনির গল্পঃ- "আপনার চেয়ে আপন"




গল্পঃ- "আপনার চেয়ে আপন"

- আর. এ. খাঁন রনি

এইত কিছুদিন আগে মারা গেলাম। কিছুদিন মানে কতদিন জানিনা। জানবইবা কিভাবে? বেঁচে থাকার সময়ে সময়ের হিসাব আর বর্তমানেরটার হিসাব এক না। আমার কিছুদিন হয়তবা ব্যস্ত পৃথিবীর কয়েকঘন্টা। আগে, মানে মৃত্যুর আগে, সেকেন্ডের কাঁটাটা শুধু সামনেই এগুতো। আর এখন সময় আস্তে আস্তে একটু এগোয়, কখনো থেমে যায়। ইচ্ছে হলে পিছিয়েও যায়। মাঝে মাঝে খুব দ্রুত ছোটে, কখনো খুব ধীরে, শামুকের মত, বিরক্তি ধরে যায়। 'শালার সময়।' মনে মনে একটা গালি দিই।

আমি যেদিন মারা গেলাম সেদিন বেশ সুন্দর হাওয়া ছেড়েছিল শহরটায়। ভীষন আপন লাগছিল ইট-কাঠের খাঁচাটাকে। হাতের মুঠোয় রাখা ছোট্ট একটা চড়ুইয়ের মত মায়া মায়া গন্ধ তার। দেখলেই চোখের আরাম হয়। অথচ বেশ কিছুদিন ধরেই আকাশে প্রচন্ড রোদ ছিল। বাইরে বেরুলে গা পুড়ে যায় অবস্থা। জানালা দিয়ে বাইরে বেশিক্ষন তাকিয়ে থাকা যায় না, চোখ করকর করে উঠত। আকাশে আর বাতাসে পিপাসার্ত কাকদের নীরব আহাজারি। সে সময়টুকু ছিল কৃষ্ণচূড়াদের জন্য বড় অসময়। কেউ রোদের ভয়ে চোখ তুলে তাকাচ্ছিল না তাদের দিকে। অবহেলিত কৃষ্ণচূড়ারা উদাস মনে বেঁচে ছিল গাছে গাছে।

অথচ আমি মারা যাওয়ার খানিক পর থেকেই শহরটা মায়ার শহর হয়ে যায়। রোদটা মাখনের মত নরম হয়ে আসে। সূর্যটা পৃথিবীর সাথে তার শত্রুতা ভুলে গিয়ে মুচকি হাসা শুরু করল। খালিচোখে দেখলে মনে হতে পারে আমার মৃত্যুর সাথে সাথে শহরটা অভিশাপমুক্ত হয়েছে। যদিও কথাটা ঠিক না হয়ত। আমার মনে হয় না আমি অভিশপ্ত ছিলাম।

কিভাবে মারা গেলাম তা আমার কাছেও খুব একটা পরিষ্কার না। রাতে সবার সাথে একসাথে বসে রাতের খাওয়া সারলাম, রুমে গিয়ে একটা বইয়ের দু'পৃষ্ঠা ওল্টালাম, একটা গানের তিন লাইন শুনলাম, কিছু ভাল্লাগছিল না। ইদানিং ঘুমরা দেরিতে আসে, ঘুমপাড়ানী মাসী-পিসীর ব্যস্ততা বেড়েছে হয়ত। শেষরাতে ঘুমাতে গেলাম। চোখের পাতায় আবছা ঘুম। সকালে বোধহয় একটু তাড়াতাড়িই ঘুম ভেঙ্গে গিয়েছিল। ঘুম থেকে উঠে দেখি মারা গেছি। এরকম হঠাৎ করে মানুষ মারা যায়! না মরলে বিশ্বাস করতাম না।

মারা যাওয়ার ব্যাপারে আপনার যথেষ্ঠ অভিজ্ঞতা না থাকলে, প্রথমদিকে আপনি ভড়কে যেতে পারেন। আমিও ভড়কে গিয়েছিলাম। এটা অনেকটা হতাশার মত গ্রাস করে নেয়। তবে প্রাথমিক ধাক্কাটা কেটে যাওয়ার পরই আমি মুগ্ধ হলাম। জানালার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা সকালটা দেখে মুগ্ধ হলাম। প্রথমেই মনে হল- সকালটা এত সুন্দর কেন? চারিদিক অদ্ভুত মায়া মায়া। আমার বারান্দা দিয়ে দূরের একটা ... গাছ দেখা যায়। গাছের কচি সবুজ পাতাগুলো সূর্যের আলোতে মিটিমিটি হাসছে। তাদের ফাঁকফোকর দিয়ে সূর্যের কয়েক টুকরো লুটোপুটি খাচ্ছে পায়ের কাছে। বাইরের রাস্তাটা নদীর মত। যেন শান্ত একটা নদী। এখুনি নদীর বুকে টুপটাপ বৃষ্টি নামবে মনে হচ্ছে। কি অদ্ভুত মায়া নিয়ে বসে আছে পৃথিবী। অথচ অন্যান্য দিন হয়ত চোখেই পড়ত না। ঘুম থেকে উঠেই অফিসে দৌড়ানোর তাড়া থাকলে কারইবা চোখে পড়বে? আজকে আমার তাড়া নেই। মৃতমানুষদের তাড়া থাকে না। আমি চোখ ভরে সকাল খেতে থাকলাম।

মা হয়ত ঘুমাচ্ছেন। ফজরের নামাজের পরের গাঢ়, শান্তির ঘুম। তাকে জাগাবো কিনা ভাবলাম। মাকে গিয়ে বলব যে আমি মারা গেছি? তবে চোখ খুলেই এরকম একটা খবর শোনা উচিৎ হবে না বোধহয়। হার্টবিটের গন্ডগোল হয়ে যেতে পারে। তাই তাকে আর জাগাতে গেলাম না। ঘুমাচ্ছে, ঘুমাক। তাছাড়া মৃত্যু কোন খুশির খবর না যে ঢাকঢোল বাজিয়ে বলে বেড়াতে হবে। আর এখন জানলেও জানবে, পরে জানলেও জানবে- একই কথা। এইসব ভাবতে ভাবতে রাস্তায় নেমে এলাম। বাইরে বৃষ্টির মত কুয়াশা পড়ছে। হাতের ছাপওয়ালা পাতলা নীল টিশার্টটা পড়ে আছি বলে হালকা শীত শীতও করছে। যেন শীতের সকাল।

রাস্তায় গাড়ির সংখ্যা কম। দানবগুলো এখনো ঘুমাচ্ছে হয়ত। পিচঢালা কালো রাস্তায় শিশিরের প্রলেপ দেয়া। বাতাসে জলের গন্ধ ভাসছে। বৃষ্টি নামতে পারে। যদিও আকাশে খুব একটা মেঘের আনাগোনা নেই, নীল রঙের আধিক্য সেখানে। নরম রাস্তার পাশের ফুটপাত দিয়ে হেঁটে চলি সামনে। ফুটপাতের বাম পাশের লাগোয়া গাছগুলোর শাখা বাতাসের প্রশ্রয়ে দুলতে থাকে, হেসে কুটিকুটি হয়। যেন খুব মজার কোন কথা শুনে মুখে শাড়ির আঁচল দিয়ে হাসছে তরুনীর দল। কুয়াশার কারনে সবুজ পাতাগুলো আরো সজীব, আরো সবুজ হয়ে আছে।

মাঝে মাঝে দু'একটা গাড়ি পাশ দিয়ে হুশহাশ বেরিয়ে যাচ্ছে। তাদের যাত্রীদের নিশ্চয়ই ভীষন তাড়া আছে। দেরি হলেই লোকসান হয়ে যাবে। আমার মাঝে মাঝে ইচ্ছে করছিল, একটা একটা করে গাড়ি থামাই। থামিয়ে তাদের আকাশ দেখাই, সবুজ দেখাই। বাতাসের কথা শুনে গাছ কিভাবে হেসে ওঠে নিজ কানে শুনুক। কচি ঘাসের ডগার উপর ঘাসফড়িং কিভাবে ধ্যান করে দেখুক তারা। কিন্তু পরক্ষনেই এই চিন্তা বাদ করে দিলাম। পাগল বলে পুলিশে দিলে হয়ত মৃতমানুষ হয়েও পার পাবো না। ইদানিং নাকি তাদের মানিব্যাগের স্বাস্থ্য ভালো না। স্যালাইন দিয়ে রাখতে হচ্ছে।

ঢাকার পার্কগুলো ছোট হয়ে আসছে। সাথে সাথে আকাশটুকুও। আকাশ ছোট হলেও শহরের পার্কের পেশাদার বাদামবিক্রেতাদের সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে। একটা পার্কের মর্যাদা নির্ভর করে তার বাদামওয়ালাদের উপর। বাদামওয়ালা হচ্ছে পার্কের শোভা। ফ্রান্সের শোভা যেমন আইফেল টাওয়ার, পার্কের শোভা হচ্ছে বাদামবিক্রেতারা। প্রেমিক-প্রেমিকারা এখন আর বাদাম খেয়ে প্রেম করে না। চাইনিজের নরম লজ্জিত আলোয় তারা প্রেম করে। তাই বাদাম ব্যবসার অবস্থা ভালো না। দেশের বাদামশিল্প আজ হুমকির মুখে। তবে আমার সামনের বাদামবিক্রেতাকে দেখে সেই কথা মনে হয় না। তার পরনে ফুলহাতা শার্ট, প্যান্ট। প্যান্টের হাঁটুর কাছে একটা তালি আছে যদিও। পায়ে জুতা। তার একপাটির মাথা দিয়ে তার বুড়ো আঙ্গুল উঁকি দিচ্ছে। এটা নিয়ে সে যথেষ্ঠ বিব্রত অবস্থায় আছে। একটু পরপর আঙ্গুল জুতার ভেতরে নেয়ার চেষ্টা করছে। তাতে খুব একটা সুবিধা হচ্ছে না। একটু পরপর মাথা বের করে পার্কের আকাশ দেখছে। তার যে মালিক তাকে নিয়ে বিব্রত, তাতে কোন পরোয়া নেই।

'স্যার, বাদাম নিবেন?'
'না'
'নিতে পারেন স্যার। ভালো বাদাম, খাইলে বাড়িঘর ভুলে যাবেন। পার্কেই পড়ে থাকবেন দিন-রাত। আমারে দেখলেই ডাক দিবেন, মফিজদ্দীন বাদাম দিয়ে যাও।'
লোকটা বেশি কথা বলে। তবে তাতে করে মফিজদ্দীনের নাম জানা গেল। তার জুতার অবস্থা দেখে মায়া লাগছে। কিছু বাদাম কিনতে পারলে হয়। কিন্তু উপায় নেই।
'আমার কাছে টাকা নেই মফিজদ্দীন'
'পরে দিয়েন তাহলে। পাঁচ টাকার দিই? দিনের প্রথম কাস্টমার'
'পরেও টাকা থাকবে নারে। আমি মারা গেছি। মরা মানুষের টাকা-পয়সা থাকে না।'
শুনে মফিজদ্দীনের চোখ ছোট হয়ে আসে চাইনিজদের মত। কপালে ভাঁজ পড়ে।
'মারা গেছেনতো বাদামের দিকে চাইয়া থাকেন কেন? শুধুশুধু এতগুলান কথা বলাইলেন।'
সে দুপদাপ পা ফেলে অন্য দিকে হেঁটে যায়। বেচারার দিনের প্রথম কাস্টমারই মরা মানুষ। মফিজদ্দীনের কপালে আজকে খারাপি আছে। মরে যাবার জন্য এইপ্রথম আমার একটু আফসোস হল। আর কখনো খোসা ছাড়িয়ে কুটুস করে বাদাম খাওয়া হবে না। কখনো কখনো ভুলে বাদামের খোসাশুদ্ধ মুখে পুরে দেয়া হবে না।

বাসে ভীষন ভীড়। পা রাখারও জায়গা নেই। মোট সংরক্ষিত সিট বারটা- মহিলাদের জন্য নয়টা আর মৃতদের জন্য তিনটা। তিনটা সিটেই মৃত প্যাসেঞ্জাররা বসে ছিল উদাস উদাস চোখ মেলে। তিনজনের মধ্যে একজনকে আমার পুরোপুরি মৃত মনে হল না।

প্রিয় আড্ডা নগরে গেলাম। বরাবরের মতই বশির,আকাশ,মেহদী ভাই'রা বসে আড্ডায় মেতেছে। তবে আজকের আড্ডার ট্রপিকটা মনে হচ্ছে সচরাচরের চেয়ে ভিন্ন। বেশ প্রাফুল্য ফুটে উঠেছে তাদের মিলনায়তনে। আমাকে দেখেই সবাই স্বাভাবিক সুরে জিজ্ঞেস করল 'কিরে মারা গেলি কখন?' গত রাতেই। এমতাবস্থায় ইয়াসিন-মোমরাজও আসলো আড্ডায় যোগ দিতে। আর আমাকে বলল 'কিরে দেখেতো মনে হচ্ছে মারা গেছিস, আবার এখানে আসছিস কেন?' ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে 'কি আর করার?' বিদায়ই নিলাম। চির বিদায়!

কলেজে গেলাম। কুইজ ছিল একটা। ইকোনমিক্সের কুইজ। কিছুই পড়িনি অবশ্য। জাস্ট দেয়ার জন্যই যাওয়া। আর যদি কারোরটা দেখার সুযোগ মিলে তাহলেতো পাঙ্খা। ক্লাসের সবার মুখে একই কথা। 'কখন মারা গেলি?','কিভাবে মারা গেলি?' এক ফ্রেন্ড(উদয়) আফসোস করল। আমি মারা গেছি সেজন্য না। নিজে এখনও বেঁচে আছে বলে। বেঁচে থাকা মানেই- ক্লাস, ল্যাব,কুইজ ইত্যাদি ইত্যাদি। আমিও চিন্তা করে দেখলাম কথা মিথ্যা না। মরে গেছি ভেবে নিজেকে কিছুটা হালকাও মনে হল। ক্লাসে স্যার আসলেন। খাতা দিচ্ছিলেন একজন একজন করে। আমি খাতা নেয়ার জন্য হাত বাড়ালাম। স্যার বললেন,'তুমি কবে মারা গেছ?'
সঠিক উত্তর জানা নেই। বললাম,'গতকাল রাতে।'
স্যার বললেন তাহলে আমার কুইজ দেয়ার দরকার নাই। বাসায় যেয়ে রেস্ট নিতে। আমি বেরিয়ে পড়লাম। আসার সময় দেখি আফসোস করা ফ্রেন্ডটার চেহারা কান্না কান্না হয়ে গেছে। বেচারা হয়ত কেঁদেই ফেলবে। আর জাহাইন্নাতো কথাই বলল না। অথচ ওর জন্য স্কুল জীবনে কত ঝামেলায় না পড়ছি শুধু ওরে বাঁচানোর জন্য। সব কয়টা স্বার্থপর।

পরক্ষনেই গেলাম রাবেয়ার সাথে দেখা করতে। ও রেগে ছিল।
'তোমার ফোনে রিং হয়। রিসিভ করো নাই কেন?'
'আমিতো মারা গেছি। রিসিভ করবো কিভাবে?'
'আজিব! মারা গেলে ফোন রিসিভ করা যায় না নাকি?'
আমি চুপ করে গেলাম। কথা বলা মানেই রাবেয়াকে আরো রাগানো। ও চোখ তুলে আমাকে ভালোভাবে দেখল।
'সত্যিই মারা গেছ তুমি? কবে?'
'কাল রাতে'
'তাহলেতো আমাদের ব্রেকআপ হয়ে গেছে। তাই না?'
'হু তাই'
রাবেয়াকে দুঃখী বা বিষ্মিত কিছুই মনে হয় হল না। অথচ মরে যাবার আগে যখন আমার একটু জ্বর কিংবা হালকা ঠান্ডাও লাগতো তখন রাবেয়ার কি আহামরি অবস্তায় না হয়ে যেত! আর এখন আমি মারা গেছি- এটা প্রিয়তমার কাছে যেন নিতান্তই স্বাভাবিক ব্যাপার। এত দিনের রিলেশনের ইতিও কোন আহামরি ব্যাপার না। আমি আবার মারা যেতে চাইলাম।
যার কাছে আমি বাঁচতে এসেছিলাম সেই যদি গলা চেপে ধরে,আষাঢ়ের শেষ রাতে আমি কার কাছে যাবো?

দাড়িয়ে আছি অবকাশ প্রান্তরে। এ যেন কাপোল-কাপোলিদের চন্দ্রনাথ। জোৎস্নায় প্লাবিত চারিদিক। তিতাস । নদীর জল চিকচিক। মৃদুমন্দ বাতাস। ঢেউয়ের তালে দুলছে উন্মাতাল দুই হৃদয়। অভিসারে বেরিয়েছেন দু’জনায়। প্রথম প্রেম আজ পরিপূর্ণতা পাবে হয়তো…

খোলা ডেকে পাশাপাশি দু’জন। নারীর এলোচুল বাউরি বাতাসে এলোমেলো। ছুঁয়ে ছুঁয়ে যায় পুরুষের চিবুক। ক্ষণিকের ছুঁয়ে যাওয়ায় সে যেন এক দিকভ্রান্ত নাবিক। হারিয়েছে পথের দিশা। তার খোলা বুক। ভিতর থেকে উকি দেয়া কালো পশমে ঢাকা চওড়া বুক, অজান্তেই ঢোক গিলতে বাধ্য করে নারীকে। জ্বলে ওঠে তার চোখ। ভিতর বাহিরে নারী অঙ্গারে পরিণত হয়। পুরুষের দিকে তাকায় একপলক। কোথায়ও কেউ নেই। চারদিকে নিঃসীম নিঃসঙ্গতায় ডুবে আছে চরাচর। একটু একটু ঢেউয়ের তালে দুলতে থাকা নিঃসঙ্গ বোটের দুই বিপরীত লিংগের মানুষ দু’জন ছন্দে ছন্দে একে অপরকে ছুঁয়ে যায়। কোথায় যেন জ্বলে যায়.. তবুও শান্ত.. কি এক ইংগিতের অপেক্ষায় মৌণ দু’জন!

নারীর অপেক্ষা সহ্য হয়না। কিন্তু দু’জনের ভিতরে কঠিন শপথ- কেউ কাউকে ছুঁবে না আগে। যে অগ্রণী ভূমিকা নেবে, তার হার হবে। তাই অসহ্য জ্বলনে কষ্টকর মুহুর্ত পার হচ্ছে নিঝুম নিমগ্নতায়!

পুরুষের শরীরের নিজস্ব ঘ্রাণে উদ্বেলিত নারী! কি এক অমোঘ আকর্ষণে একটু ঝুঁকে পড়ে সে পুরুষের দিকে। তার এক চোখ নিজের অবাধ্য চুলে ঢেকে আছে। অন্যটি পূর্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। অস্ফুট নিরব মিনতি তার কাঁপন ধরানো চোখের তারায়। গোলাপী ঠোঁটের নিজেদের জোর করে চেপে রাখার অপপ্রয়াস হঠাৎ বিচ্ছিন্ন হয় নারীর সুরেলা কণ্ঠের ঝংকারে-

“ধীরে ধীরে তোমার সমস্ত হাসির রং হলুদ
ধীরে ধীরে তোমার সমস্ত গয়নায় শ্যাওলা
ধীরে ধীরে তোমার মখমল বিছানা
ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টিতে, ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টিতে সাদা ।
সেই সাপটা বুঝি তুমি ?
না।
তবে ?
স্মৃতি।
বাসর ঘরে ঢুকার সময় যাকে ফেলে এসেছিলে
পোড়া ধুপের পাশে।”

পুরুষ এতক্ষণ নিজের পৌরুষকে অবদমিত করে রেখেছিলো শপথের কঠিন নিষেধের বেড়াজালে। নিঃসঙ্গ যুবতীর শরীর ছাপিয়ে বাতাসে ভেসে বেড়ানো কামনার বহ্নিশিখারা, এক মায়াবী কোমল নারীর সুরেলা মধুমাখা আবৃত্তি শুনে-নিজেরাই নিজেদের শরীর পেট্রোলে ভিজিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়! জ্বলে ওঠে পুরুষের আপাদমস্তক.. সে বিস্ফারিত নেত্রে কল্পনায় নারীর শরীরের বাঁকে বাঁকে নিজের ভিতরের নিজকে অবগাহনরত দেখে। আপনাতেই তার মুখ দিয়ে বের হয়-

“বরফের কুঁচির মতন
সেই জল মেয়েদের স্তন!
মুখ বুক ভিজে,
ফেনার শেমিজে
শরীর পিছল!”

আরো একটু আসে নারী! নিঃশ্বাস ঘন দূরত্ব দু’জনের.. হৃদয়ের সিস্টোল-ডায়াস্টোল দামামা বাজিয়ে চলেছে.. নাকের পাটা ফুলে ফেপে একাকার.. কিছু একটা আটকে আসতে চায় গলার কাছে নারীর! মনে মনে বলে সে, ‘ধুর ছাই! জাহান্নামে যাক শপথ’.. মুখে বলে-

“তোমাকে দেখার মতো চোখ নাই, তবু,
গভীর বিস্ময়ে আমি টের পাই- তুমি
আজো এই পৃথিবীতে রয়ে গেছো।

নারী নিজেই সমর্পিত হয় পুরুষের বাহুডোরে.. রুপালী চাঁদ জোৎস্না কে বলে ধীরে বহো.. নদীর জলে চিকচিক করে নারীর কালো এলোচুল! পুরুষ নারীর বাঁকে বাঁকে রসুনের খোসার মতো পরতের পর পরত খুলে অবগাহন করে আর বলে, ‘হ্যা! আমি আজো এই পৃথিবীতে রয়ে গেছি কেবলি তোমার জন্য!’

এক নিঃসঙ্গ বোটে- নদীর ঢেউয়ের তালে তালে, চাঁদ আর জোৎস্নাকে সাথে নিয়ে, ছন্দে ছন্দে কাঁপন ধরিয়ে যায় ফেরারি সময়।।
রাত হয়েছে। বাসায় ফিরতে হবে।

রাস্তায় হাঁটছি। আমার মৃত্যতে কারো কোন দুঃখ নেই। দুঃখতো পরের কথা; বিষ্ময়ও নেই। বেঁচে থাকলে মনটা বেশ খারাপ হত। মৃত মানুষের মনই নেই; খারাপ হবে কি। এখন একটা সিগারেট টানতে পারলে মন্দ হত না। বুক ভরে নিতাম নষ্ট নিকোটিনে। একটা টঙের দিকে এগোলাম। সিগারেট কিনব।

দোকানদার সরুচোখে তাকিয়ে আছে। 'আপনে কি মারা গেছেন?'
'হু। কাল রাতে।'
'তাইলে আপনে সিগারেট দিয়া কি করবেন? মারা গেলেতো বিড়ি খাওয়া যায় না।'
'কিছু করব না। ফালাইয়া দিব'
'সিগারেট বেচুম না। মরা মাইনষের কাছে সিগারেট বেচি না।'

বাসার উদ্দেশ্যে রওয়ানা।
ওপরে আকাশের দিকে তাকাচ্ছি আর মনে পড়ে যাচ্ছে স্মৃতিময় সব মূহুর্তগুলো।

"চাঁদ মামা আজ বড্ড একা বড় হয়েছি আমি,
রোজ রাতে আর হয়না কথা,
হয়না নেওয়া হামি।

রোজ রাতে আর চাঁদের বুড়ি কাটেনা চরকা রোজ,
ও বুড়ি তুই আছিস কেমন?
হয়না নেয়া খোঁজ!

কোথায় গেল সেই রূপকথার রাত হাজার গল্প শোনা?
রাজার কুমার,কোটালকুমার,পক্ষীরাজ
সে ঘোড়া!
আলাদিন আর জাদুর জিনে আমায় ডাকছে শোনো...
ব্যস্ত আমি ভীষণ রকম সময় তো নেই কোন।

আলিবাবার দরজা খোলা চল্লিশ চোর এলে
সিন্দাবাদটা একলা বসে আছে সাগর তীরে।
সময়টা আজ কেমন যেন বড় হয়ে গেছি আমি
তারা গুলো আজও মেঘের আড়াল কোথায় গিয়ে নামি?

কেড়ে নিলো কে সে আজব সময়
আমার কাজলা দিদি!"

এই মুহূর্তে ভিষণ আপন মনে হচ্ছে 'ওল্ড স্কুলের' কথা গুলো।
হায় আমার শৈশব!
ফেলে আসা লাল গোলাপ।

আমার এই অন্তিম বিষাদ কালে-
চঁন্দ্রিমা,ইন্দুবালা,চঁন্দ্রপ্রভাদের খোঁজই মিলেনি। আর চঁন্দ্রলেখাতো সেই কবেই হারিয়েছে।

চলার পথে রিফাত ভাইয়ের প্রিয়তমার সাথে দেখা। আমাকে দেখা মাত্রই দৌড়ে এসে কাঁদো কাঁদো গলায় বলে তাদের নাকি অনেক দিন ধরে কোনো যোগাযোগ নেই। 'আপনি কিছু একটা করেন ওরে ছাড়া আমি বাঁচতে চায় না এই পৃথিবীতে। তাইলে মঙ্গলে চলে যাওনা কেন?(মনে মনে বললাম)। এমনিতেই আমার আমি মরে গেছি তার মাঝে উনার আলগা পিরিতি। আমি বিষয়টা খুলে বললাম- আমি মারা গেছি। 'মারা গেছেনতো কি হয়ছে? এই ধরেন এই চিঠিটা শুধু ওর কাছে দিয়ে দিবেন আর কিছু করতে হবেনা আপনাকে' এই বলে চলে গেল। এখন চিঠিটা আমি কি করে পৌছায়? মরে গিয়েও শান্তি নাই এই কাপোত-কাপোতিদের জন্যে। কি আর করার যা আছে কপালে।

বাসার অতি নিকটে এসে অবশেষে দেখা মিলল রকি আর হাবিবের সাথে। চিরচেনা পুকুর পাড় গল্পে মগ্ন তাহারা। আমাকে দেখা মাত্রই তারা আতকে উঠে আর বলে 'শুনলাম তুমি নাকি মারা গেছ? মরা মানুষ হইয়া এতো রাতে বাহিরে কি?'
এই কথা শুনে তাদের সাথে কথা বলার ইচ্ছাটাই মরে গেল। ও আমি নিজেইতো মরা।
অতঃপর মনে পড়ে গেল চিরকোটের 'আহারে জীবন!'

এই চরম বাস্তবিক মুহূর্তে মনে পড়ছে একজন মহা কবি'র মহা কাব্য'কে। যার অন্তরে  সর্বদাই মানবতার প্রবাহমান স্রোত বিদ্যমান। তার নাম বললে বা লিখলে মনের অজান্তেই ভাই নামক ভালবাসার  সূত্রটি চলে আসে। হ্যাঁ তিনি 'জুনায়েদ ইভান ভাই'।

- "আমাদের জীবনে দুটো রেল লাইন আছে। একটা ইমোশন আরেকটি রিয়্যালিটি !

বেশিরভাগ মানুষ যেকোন একটাতে আটকে যায়। হয় খুব বাস্তববাদী হয়; কর্পোরেট ভালোবাসায় নিয়ম করে ঘড়ি ধরে চুমো খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে ! আর নাহয় চোখের দিকে তাকানোই যায় না-  আবেগে থরথর করে কাঁপতে থাকে।

যে কবিতা পড়ার পর প্রবল আবেগে আপনার মরে যেতে ইচ্ছে করে,  কর্পোরেট লাইফের এই দুনিয়াটাকে অনর্থক নিরর্থক মনে হয় সেই কবিতারও একটা মজবুত রিয়্যালিটি আছে। কবি কিন্তু তার পংক্তিমালা ব্যাগে করে নিয়ে প্রকাশকের সাথে আলাপ করেছেন। যে পংক্তিমালা পাঠ করে আপনি ফ্লোরে চিত হয়ে পড়েছিলেন, সেই পংক্তিমালার আবেগের দামে টেবিলের উপরে রাখা ক্যালকুলেটর দিয়ে কবি তার প্রাপ্য কমিশনের  হিসেব কষেছেন ! বেঁচে থাকার জন্য দুটোরই দরকার আছে।  তানাহলে  ওরা আপনাকে বাঁচতে দেবে না। 

খুব সামাজিক কিংবা খুব অসামাজিক কোনটাই আসলে ভালো না।  কারো চিন্তা চেতনা আমার সাথে মেলে না তাই আমার চিন্তার অংশে আমি কাউকে রাখব না - এসব অনেক মান্ধাতা আমলের ফিলোসফি। কিছু সয়ে যেতে হয়, কিছু আপনাতেই সয়ে যায়। সব কিছু নিয়েই জীবন।

অফিস পাড়ায় রোদে দর কষাকষি আর শ্রাবণের বৃষ্টিতে কাউকে লং রোডে নিয়ে সব বিলিয়ে দেয়া - দুটোই জীবনের সুন্দর অংশ।  বৃষ্টির রাতে লং রোডে ঘুরতে বের হবার পয়সাটা অফিস পাড়ায় রোদে দর কষাকষি থেকেই আসে। দুটোই সুন্দর। দুটোকে আলাদা করে দেখতে গেলেই যত দ্বন্দ্ব।

কোনদিনও নিজের ইমোশনের কাছে হেরে যাবেন না।  যখন এই পৃথিবীটাকে একটা স্বার্থপর গ্রহ মনে হবে; সব কিছু ছেড়ে ছুড়ে হেরে যেতে ইচ্ছে করবে তখন পা ফেলতে হবে রিয়্যালিটিতে।"
হ্যাঁ আমি এখন দ্বিতীয়টিতে দন্ডায়মান।

সারাদিন বেশ ভাব ধরে ছিলাম। ভাব ধরে ছিলাম- মরে গেছি তাতে কি। কিন্তু তাদের ব্যাপারটায় নতুনকরে উপলব্ধি হল- আমি মারা গেছি। আসলেই মারা গেছি। ভরা পূর্নিমার ফিনকি দিয়ে পড়া জ্যোৎস্না আমি দেখব; কিন্তু জ্যোৎস্নারা আমাকে ছুঁবে না। অকৃতজ্ঞের মতো আমাকে উপেক্ষা করে মাটিতে পড়বে। তারা ভুলে যাবে তাদের জন্য লেখা আমার কবিতার ঋণ। কেউই আমার আপন হইলনা। শুধু আপন হলো অসম্ভব ভয়ংকর লাশকাটা ঘর। আমার আপন নীড়।। 
সমুদ্রে জাহাজ নেই, অতলে ডুবে গেছে ক্যাপ্টেন। এম্বুলেন্স অসুস্থ; লাশের কপালে দুঃখ আছে।

মৃতরা কাঁদে না; কাঁদতে পারে না। চোখ দিয়ে অশ্রু না গড়ালেও যে কেউ দেখলে বুঝত আমি কাঁদছি। একজন মৃত মানুষ কাঁদছে।

প্রয়োজনে:-  01611501136

 

Saturday, July 10, 2021

কবি সাইদুল ইসলাম এর সংক্ষিপ্ত জীবনী:

 


কবি সাইদুল ইসলাম এর সংক্ষিপ্ত জীবনী:


বাংলা সাহিত্যের অন্যতম কবি, সঙ্গীতজ্ঞ, সঙ্গীতস্রষ্টা, কবি-কথাসাহিত্যিক, কন্ঠশিল্পী, সুরকার ও গীতিকার বাংলাদেশ বেতার ও টেলিভিশন বিটিভি ঢাকা। 


আলহাজ্ব মোহাম্মদ কবি সাইদুল ইসলাম এক দরিদ্র মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। ভাগ্যের নির্দয়তায় ছোট বেলা থেকেই কবি বেঁচে থাকার তাগিদে লড়াই করতে শুরু করেন। গৃহস্থের বাড়ী রাখালীতেই কবির বাল্য জীবন অতিবাহিত হয়। দীর্ঘ ৬ বছর পর  রাখালী ছেড়ে কবি বাবার সাথে কৃষি কার্যে যোগ দেন। দীন মজুরী দিয়ে সংসারের ব্যয় খাতে বাবাকে সাহায্য করতেন তিনি। কবির বয়স তখন মাত্র ১৩ বছর।  এত অল্প বয়সেও কবি সংসারের দুর্দশা এড়িয়ে যেতে পারেননি। কবি সাইদুল ইসলাম এর কন্ঠের মাধুর্যতাও কিন্তু অসাধারণ ছিলো। আবদুল আলীমের পল্লী গীতি গানের সুরে সুরে শত জনতার ভীড় জমিয়ে তুলতেন কবি কখনো সারা মাঠের রাখাল দের নিয়ে গানের প্রতিযোগিতা করতেন তিনি। দিনের বেলায় বাবার সাথে মজুরী আর রাতের বেলা প্রতিবেশীদের শিক্ষিত ছেলে মেয়ের কাছে অ, আ,শিখতে লাগলেন কবি। এ ভাবেই চলতে থাকে কবির লেখা পড়ার কাজ। এক সময় স্বাধীন হলেন কবি, স্কুলে ভর্তি হলেন। অতি অল্প সময়ের মধ্যেই প্রথম শ্রেণীর বই উত্তীর্ণ হয়ে দ্বিতীয় শ্রেণীতে হাতে খড়ি তোলেন কবি সাইদুল ইসলাম। পেশায় কৃষক এহেন মানুষটির পড়াশোনা কিন্তু এস এস সি অবধি। জ্ঞান যে প্রথাগত শিক্ষার ধার ধারে না তার জলজ্যান্ত উদারণ তিনি। ৭০ বছরের এই বৃদ্ধাকে চিনতে পারবেন প্রায় অনেকেই কুষ্টিয়া জেলা ধীন মিরপুর উপজেলার অন্তর্গত প্রসিদ্ধ খয়ের পুর গ্রামের এই মানুষটা। কবি নামে এক ডাকে চেনেন প্রায় সকলেই। চিনবে না-ই বা কেন?। কবি সাইদুল ইসলাম। তিনি শুধু কবি ও লেখকই নন। একজন গীতিকারও বটে। বাংলাদেশ বেতার ও টেলিভিশন বিটিভি এর তালিকাভূক্ত গীতিকার ও সুরকার এবং কন্ঠশিল্পী, কবি ও কথাসাহিত্যিক। অনায়াসে দক্ষতায় সাহিত্য চর্চা, সাহিত্য সেবা, সাহিত্য রচনা করেন। তখন কে বলবে প্রথাগত ডিগ্রি নেই তার। কবি নিজেই জানালেন ছোটবেলার কথা পাঁচ ভাই ও তিন বোনের সংসারে কবি ভাইদের মধ্যে তৃতীয় সন্তান। জীবন সংগ্রাম সেই শুরু কিন্তু ভাঁটা পড়েনি বই প্রেমেতে অভাবে স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়। চেয়েচিন্তে বই আনতেন তাঁর পিতা মরহুম আমোদ আলী, মাতা খদেজা খাতুন। নিরক্ষর হলেও বইয়ের কদর জানতেন। দরিদ্র পরিবারের ধান বিক্রির টাকায় কেনা হতো বই। চাষের কাজের পাশাপাশি সাহিত্য কাজ সেই সঙ্গে পড়াশোনা চলতে থাকে। লেখক, কবি, সাহিত্যিক, শিল্পী, সুরকার ও গীতিকার, সঙ্গীতস্রষ্টা কবি সাইদুল ইসলাম। ১৯৫১ সালে ৭ অক্টোবর জন্মগ্রহণ করেন। শ্রদ্ধা জানাই প্রিয় কবির প্রতি। মাত্র ১৭ বছর বয়সে কবি তার সাহিত্য কর্মময় জীবন শুরু করেন, সাহিত্য সাধনায় আত্ননিয়োগ করেন। কবি হিসেবেই তিনি অধিক পরিচিতি।  কবির চার ছেলে এক মেয়ে নিয়ে সংসার। কবির দুই ছেলেও চাষবাস করে সংসার চালান। সংসারে টানাটানি থাকলে কি হবে বাবাকে উৎসাহ জোগান তাঁরা। কবির দ্বিতীয় ছেলে সাঈদ রাজা জানালেন যতই দরিদ্র থাকুক বাবাকে বাধা দেওয়ার কোনও প্রশ্নই নেই। এক মুখ খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি পরনে তালি দেয়া আধময়লা জামা কাপড় নিতান্তই সাধারণ চেহারার মানুষটা যে এমন অসাধারণ সাধনায় মেতে রয়েছেন তা নিয়ে গর্বিত প্রতিবেশীরাও। একটু স্বাচ্ছন্দ্যের আশায় নিজের লেখা গান গাইতে শুরু করেন কবি।  লোকমুখে খ্যাতি ছড়িয়ে পড়তে বেশি সময় লাগেনি। এখানেই শেষ নয়, ছোটবেলায় ছুটে বেড়িয়েছেন দেশের বিভিন্ন জেলায় কবিতা ও গানের জগতে। নানীর অর্থনুকূল্যে গ্রামেই ফার্ম রোডস্থ একটা মুদী দোকান দেন কবি  এখানেই লেখা পড়ার পাশাপাশি সাহিত্যের হাতে খড়ি। কবির হাতে গান ও কবিতা লেখার প্রথম ঘড়ি ওঠে। চলতে থাকে মুদী দোকান সেই সঙ্গে পড়াশোনা ও সাহিত্য রচনা। 


দুঃখ কষ্টের মধ্যে দিয়ে লেখা পড়ার কাজ চালিয়ে গেছেন তিনি আমলা সদরপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে ১৯৭২ সালে এস এস সি পাশ করেন কবি পরবর্তী জীবনে পেশা হিসেবে বাংলাদেশ পুলিশ লাইন্সে যোগদান করেন। কুষ্টিয়া পুলিশ লাইন্সে যোগদান করে ট্রেনিং গ্রহণ করেন রাজশাহীর সারদায়। পরে  পোস্টিং হয় পাবনা জেলায়। কিন্তু শিল্পী সাহিত্য মন উড়ন্ত ছন্নছাড়া জীবন বাধা ধরা নিয়মে আটকে থাকতে পারেনি তিনি। দুই বছর মত চাকুরী করে চাকরি ছেড়ে ফিরে আসেন গ্রামে, সেই সুরের সংগীত সাহিত্য সাধনায়। ছুটে চলেন কবিতা ও গানের নেশায় দেশের বিভিন্ন জেলায়। পরবর্তী জীবনে পেশা হিসেবে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীতে আবার চাকুরিতে  যোগদান করেন কবি। সেখানেও সাহিত্য শিল্পী মন স্থির করতে পারেননি, চাকুরী ছেড়ে ফিরে আসেন কবিতা ও গানের জগতে।



 ৪০ বছর সাহিত্য কর্মময় জীবনে এযাবত তিনি একটানা ধ্যান সাধনায় তিনি প্রায় ১০ হাজারের মতো গান লিখেছেন। নিজের লেখা গান, তিনি নিজেই সুর করেন। কবি লিখেছেন বহু কবিতা, নাটক, উপন্যাস, চারণ কবিতা, প্রবন্ধ, ছোটগল্প, ছড়া, গীতি কবিতা ও গীতি নাটক পান্ডুলিপিবদ্ধ করেছেন। গরীব কবি হিসেবে কবির সাহিত্য সম্ভার থেকে প্রকাশিত হয়েছে অনেক গুলো কাব্যগ্রন্থের বই। নব রোশনাই কবিতা, সাহিত্য মন্থন কবিতা, শাশ্বত চাঁদ কবিতা, হাহাকার উপন্যাস, দাহ পেষণ কবিতা, চারণ কবিতা রক্ত মিছিল, আমি বিদ্রোহী কবিতা, বিধুর সমাধি উপন্যাস, খুঁনে ঢাঁকা ইরাক রক্তাক্ত বাগদাদ কবিতা, মহাপ্রান্ত প্রথম খন্ড বিশেষ উল্লেখ যোগ্য।



 এছাড়াও প্রকাশিত হয়েছে কবির লেখা গান নিজের সুরে নিজের কন্ঠে গাওয়া ১১ টি গীতি কাহিনীর ক্যাসেট এবং আধুনিক গানের ক্যাসেট প্রকাশিত সিডি ও রয়েছে তার। এছাড়াও কবি সাইদুল ইসলাম এর লেখা বিভিন্ন সাহিত্য ছোট কাগজে ও প্রকাশিত হয়েছে। প্রকাশের তালিকায় রয়েছে গান ও কবিতা উপন্যাসের বই। এ ছাড়া কবি সাইদুল ইসলাম "প্রতিক্ষা" নামক একটি বাংলা সাহিত্য পএিকায় তিনি অত্যান্ত সুদক্ষতার সাথে সম্পাদনা করেছেন। বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন খেত্রে স্বচ্ছন্দ বিচরণ করে যাচ্ছেন তিনি সাহিত্য চর্চা, সাহিত্য সেবা, সাহিত্য রচনা মানেই কবির অপর জীবন। তার সাহিত্যকর্মে প্রাধান্য পেয়েছে ভালোবাসা।



Monday, July 5, 2021

হাঁটুর ব্যথা কমাতে সঠিক ডায়েট


হাঁটুর ব্যথা কমাতে সঠিক ডায়েট 


 হাঁটুর ব্যথা একটি পরিচিত সমস্যা। যাদের সবসময় এই ব্যথা থাকে একটু সিঁড়ি ভাঙলে কিংবা হাঁটলে ব্যথা আরও বেড়ে যায়। কারও কারও হাঁটু ব্যথা অল্প হয়, কারও বা বেশি। কোনো কোনো ক্ষেত্রে হাঁটুর ব্যথার জন্য অপারেশনেরও প্রয়োজন পড়ে। 

বয়স একটু বাড়লেই সকলের মধ্যে যে সমস্যা দেখা যায় তা হল হাঁটুর ব্যথা৷ সকলেই অল্প বিস্তর এই সমস্যার শিকার৷ তেল মালিশ বা এক্সারসাইজেও অনেক সময় হ্যাটুর ব্যথা থেকে রেহাই পাওয়া যায় না৷ হাঁটুর ব্যথাকে বশে আনতে আপনার খাদ্যাভ্যাসকে সঠিক রাখতে হবে৷ শরীরের বৃদ্ধি নিয়ে হওয়া এক গবেষণায় দেখা গেছে ডায়েটের দিকে সামান্য খেয়াল রাখলেই এই সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়৷

কিন্তু এই ব্যথা যদি আর্থাইটিস, আঘাত পাওয়া কিংবা  সামান্য কারণে হয় তাহলে তা বাড়িতেই নিরাময় সম্ভব। তবে কি কারণে হাঁটু ব্যথা হচ্ছে সেটা জানার জন্য সবারই এক্স- রে করা প্রয়োজন।

 হাঁটুর ব্যথা নিরাময়ের অন্যতম সহজ পদ্ধতি হলো আক্রান্ত স্থানে বরফের ব্যবহার। এক টুকরা বরফ নিয়ে তা পাতলা একটা তোয়ালে দিয়ে মুড়িয়ে আক্রান্ত স্থানে ২০ থেকে ৩০ মিনিট ঘষুন। দিনে ২ থেকে ৩ বার এটি করলে ব্যথা অনেকটাই কমে যাবে। 

আপেল সিডার ভিনেগার হাঁটুর ব্যথা নিরাময়ে বেশ কার্যকরী। এক গ্লাস পানিতে ২ টেবিলচামচ  আপেল সিডার ভিনেগার মিশিয়ে দিনে কয়েক বার পান করুন। অথবা অলিভ অয়েলের সঙ্গে এটা মিশিয়ে আক্রান্ত স্থানে ম্যাসাজ করুন। কিংবা পানির মধ্যে ভিনেগার মিশিয়ে ৩০ মিনিট পর হাঁটুতে লাগান। কয়েকদিন এটা করলে ব্যথা অনেকটা কমে যাবে। 

মরিচের গুড়াও হাঁটু ব্যথার জন্য বেশ কার্যকরী। এক কাপ হালকা গরম অলিভ অয়েলের সঙ্গে দুই টেবিল চামচ মরিচের গুড়া মিশিয়ে হাঁটুতে ম্যাসাজ করুন। আর্থাইটিসের ব্যথায় যারা ভূগছেন তারা আরাম পাবেন। সপ্তাহে দুইদিন এটা লাগালে হাঁটুর ব্যথা অনেকটা কমে যাবে। 

হাঁটুর ব্যথা কমানোর আরেকটা পদ্ধতি আছে। কিছু আদা থেতলে নিয়ে পানির মধ্যে ১০ মিনিট ধরে সিদ্ধ করুন। এরপর এতে সামান্য মধু এবং লেবুর রস মিশিয়ে নিন। দিনে ২ থেকে ৩ বার এই মিশ্রণটি পান করলে হাঁটুর ব্যথায় অনেকখানি আরাম বোধ করবেন। 

হাঁটুর ব্যথা নিরাময়ে কিছুটা হলুদ নিয়ে পানির মধ্যে ১০ মিনিট ভালভাবে ফুটিয়ে নিন। এরপর এর সঙ্গে মধু মিশিয়ে পান করুন। আবার এক কাপ দুধের সঙ্গে হলুদ আর আদা মিশিয়ে খেলেও হাঁটু ব্যথা নিরাময় হবে । তবে হাঁটু ব্যথার জন্য নিয়মিত ওষুধ খেলে হলুদ খাওয়া ঠিক নয়। 

অতিরিক্ত ওজনের কারণে অনেকসময় হাঁটু ব্যথা হয়। এজন্য ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখুন। এছাড়া হাঁটুর জন্য যেসব ব্যয়াম আছে সেইগুলি নিয়মিত করলে ব্যথা অনেকটা কমে যাবে। 

• হাঁটুর ব্যথা কমাতে সবচেয়ে কার্যকরী হলো মাছ৷ মাছে এমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড সবচেয়ে বেশি পরিমাণে থাকে৷ ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড বয়সজনিত হাঁটুর ব্যথা, পায়ে আড়ষ্ঠতা বা আর্থারাইটিসের মত সমস্যাকে দূরে রাখতে পারে৷
• কমলালেবুর রসে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি বর্তমান৷ ভিটামিন সি হাঁটুর ব্যথা সাড়াতে এক কার্যকরি ওষুধ৷ এছাড়াও এটি হাঁটুর অস্টিওআর্থারাইটিসের সমস্যা থেকে মুক্তি দিতে পারে৷
• পালং শাক ও পেঁয়াজে প্রচুর পরিমামে লুটেইন ও জিয়াক্সঅ্যানথিন নামের অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট থাকে৷ এটি অস্টিওআর্থারাইটিসের ফলে হওয়া হাঁটুর ব্যথায় উপশম দিতে পারে৷ পেঁয়াজে কুয়েরসেটিন নামের একধরণের ফ্ল্যাভেনয়েড থাকে৷ এটিও হাঁটুর ব্যথা কমাতে কার্যকরি৷
• দাঁড়াতে বা হাঁটতে গেলে যে ধরনের হাঁটুর ব্যথা অনুভব হয় তা কমাতে সবচেয়ে কার্যকরি হল আদার রস৷ এছাড়াও রান্নায় আদা ব্যবহারের ফলেও হাঁটুর ব্যথা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়৷
• গবেষণায় দেখা গেছে রিফাইন কার্বোহাইড্রেট প্রদাহের সমস্যা বাড়িয়ে দিতে পারে৷ তাই খাবারের তালিকা থেকে এই ধরনের কার্বোহাইড্রেট বাদ দিন৷
(সংগৃহীত)

ফজলুর রহমানের লেখা ছোট গল্প নি:শব্দে নির্বাসন



নিঃশব্দে নির্বাসন

                                       ফজলুর রহমান


 

দুটি বোবা নর-নারীর মধ্যে বিয়ে হয়ে গেল। ছেলেটি গাঁদা ফুলের মালা মেয়েটির গলায় পরিয়ে দিল। মেয়েটিও সজ ভঙ্গিতে কাঁপা কাঁপা হাতে ছেলেটির গলায় ঐ একই ফুলের মালা পরিয়ে দিল। এবার মেয়েটির যা দুই চারজন বান্ধবি ছিল তারা খলবলিয়ে হেসে উঠলো ঠিকই কিন্তু বিদ্যুৎ না থাকায় হেরিকেনের টিমটিমে আলোয় সে হাসি চোখ চেয়ে দেখা গেল না। কেবল একটা রোল খানিকক্ষণ গুঞ্জরিত হয়ে নিশ্চুপ হয়ে গেল। যেহেতু কোনো ধনী মানুষের বিয়ের আয়োজন এটা নয় তাই কাঁচা বেলী বা গোলাপের মালার ব্যবস্থা কেন নেই সে প্রশ্ন এখানে অবান্তর। তবে গাঁদা ফুলগুলো টাটকা। আজকেই তোলা। ছেলেটির একমাত্র বন্ধু বাদল এক ফুল বিক্রেতার বাড়ি গিয়ে কিনে এনেছে। বিয়েতে কোনো নিয়ন আলো জ্বলেনি, কোনো কোর্মা-পোলাও রান্না হয়নি। কার গাড়িতে চেপে ধুলা উড়িয়ে নানান বাদ্য-বাজনা বাজিয়ে লটবহর সমেত বরযাত্রা আসেনি। লোক জন যা এসেছে তা হাতের কড়ে আঙুলে গোনা যায়। কনের বাসা একরুম বিশিষ্ট। বাসার সামনে এক চিলতে দাঁড়ানোর জায়গা। সে জায়গাটুকু আবার বাড়িওয়ালার। অপরিসর রুমটির মাঝখানের চৌকিতে বসানো হয়েছে বর ও কনেকে। তাদেরকে ঘিরে অপ্রসস্ত জায়গা জুড়ে বিয়ে বাড়ির চেনা-অচেনা লোক জন। বিদ্যুৎহীন চৈত্রের গুমোট সন্ধ্যায় মানুষের ঘেমো শরীরের একটা কূট গন্ধ হেরিকেনের অবছা অন্ধকারে  ধোঁয়ার মতো ছড়িয়ে পড়েছে। থেকে থেকে জন্তু-জানোয়ারের মতো একটা গুতোগুতির শব্দ, অশ্লীল ফিসফাস বাক্যালাপ ও অট্টহাসির শব্দ শোনা যাচ্ছে। নিতান্ত সাদামাটা ঘরোয়া এ আয়োজনে ছেলেটি ভেবেছিল মানুষের ভিড়-ভাট্টা, হৈ-চৈ তেমন হবে না। কথা বলতে না পারা দুটি মানুষের বিয়ে - এতে অন্য মানুষেরা কী আর আগ্রহ দেখাবে ? কিন্তু অপরিসর রুমটিতে জামাই-বউ দেখতে আসা নারী পুরুষের উপচে পড়া ভিড় দেখে ছেলেটি ভাবলো চিড়িয়াখানার জন্তু দেখতেও এতো ভিড় হয় না। তারা বোবা বলে উপস্থিত উৎসুক জনতা তাদেরকে  সার্কাস দলের নট-নটীদের মতো আপদমস্তক নিরীক্ষণ করে দেখচ্ছে। তাদের চোখে-মুখে কটাক্ষের ভাব। বিয়ের মতো এমন মর্যাদাপূর্ণ কাজ তোমাদের মতো দুটি বোবা মানুষের আবার কেন করার দরকার পড়ল ? এসবে তো আমাদেরই একাট্টা অধিকার। কেউ কেউ মুখ টিপে টিপে বিকৃত হাসি হেসে অন্যের গায়ে ঢলে গড়িয়ে পড়তে পড়তে ফিসফিস করে বলে চললো - ‘আরে বোন ওসব কথা বলো না বোবা বলে কী সখ-আহ্লাদ থাকতে নেই না কী ? রাতে স্বামীর কোলে শুয়ে...’ তারপরের কথাটুকু আর উচ্চারণ যোগ্য নয়।

বিয়ের সব অনুষ্ঠানিকতা শেষ হতে রাত সাড়ে নটা বেজে গেল। তারপর কালোমতো স্থূলদেহী এক মহিলা এসে মৌচাকে টিল মারা মতো করে বাজখাই গলাই বলল - ‘মাগিগোর কোনো কাম-কাইজ নাই না কি ? বোবা দুইডা মাইনষের বিয়া দেখইন লাইগ্যা ঘণ্টর পর ঘণ্টা খাড়াই রইছে। ঔই সব বড়িত যাওনা ক্যান? এহানে কী মধু ঝইর‌্যা পড়ে ? না রহিম রূপভান যাত্রাপালা চলে ? যাও কইতাছি হারামজাদির দল।’ স্থূলদেহী মহিলার কথায় কাজ হলো। দর্শনার্থীর অধিকাংশ ছিল মহিলা আর উঠতি বয়সী পোলা-মাইয়া। এদের বেশিরভাগ পোশাক শিল্প শ্রমিক। সবাই এক এক করে বিয়েবাড়ি হতে বিদায় নিতে শুরু করলো। মিনিট দশেক হলো বিদুৎ এসেছে। সকলে একে একে বিদায় নিলে স্থূলদেহী মহিলাটির পরিচয় জানা গেল। সে বাড়িওয়ালী। নাম হাজেরা। স্বামী বেঁচে নেই। স্বামী পোশাক কারখানার ইলেকট্রিশিয়ান ছিলেন। বাড়িওয়ালীর আদি নিবাস ঢাকার গাবতলী। যে দুটি নর-নারীর বিয়ে হলো ওরা  পোশাক শ্রমিক। ছেলেটি নাম টগর আর মেয়েটি পারুল। সবাই  ছোটো করে পারু বলে ডাকে। টগর থাকে চট্টগ্রাম বদ্দারহাট। আর পারুর বাসা নাসিরাবাদ। অবশ্য আজ রাত থেকে তার ঠিকানা হবে বদ্দারহাট। আজকে সে এ বাসা ছেড়ে দিচ্ছে। বিয়ের দিন কোনো মেয়ের একেবারে বাসা ছেড়ে দেওয়ার ঘটনা বিরল। পারুলের কোনো বাবা নেই। তার বাবা-মা কেউ বেঁচে নেই। তার কোনো ভাই বোনও নেই। তাদের বাড়ি ছিল ঢাকা সাভারের হেমায়েতপুর বাজার বাসস্ট্যাণ্ডের নিকটে। বাবা ছিল সবজি বিক্রেতা। বাবা-মা মারা যাওয়ার পর বিধবা দাদির সাথে চট্টগামে নাসিরাবাদে একটা বস্তিতে উঠে আজ থেকে দশ বছর আগে। তখন পারুর বয়স ছিল  পনেরো বছর। দাদি গুলনাহার একটা পোশাক কারখানায় ডাইং এর কাজ পেয়ে যায়। অজানা অচেনা শহরে একটা চাকরি ও মাথা গোজার ঠাঁই পেয়ে দুটি অসহায় নারী বেঁচে-বর্তে যায়। এখন গুলনাহারের বয়স হয়েছে। তার বয়স ষাট। গুলনাহার এতোদিন নাতনিকে কিছু করতে না দিলেও গত এক বছর পারু গুলনাহারকে আর কারখানায় যেতে দিচ্ছে না। দাদির পরিবর্তে সে নিজেই গুলনাহার যে কারখানায় কাজ করতো সেখানে জয়েন করেছে। গুলনাহার প্রথমে বাধা দিলে পরে পারুর জিদ আর নিজের বয়সের কাছে সে বাধা পরাজিত হয়েছে। কারখানার মালিক ভালো। আর অনেকদিন ধরে কাজ করায় গুলনাহার তার বোবা নাতনির জন্য মালিককে ধরে বসলে মালিক প্রথমে আমতা আমতা করলে গুলনাহার বলেছিল -

‘পারু বোবা হলে কী হবে স্যার ও ভালো সেলাইয়ের কাজ জানে। আপনি ওকে সুইং এ লাগিয়ে দিন। দেখিয়ে-শিখিয়ে দিলে দেখবেন ও ঠিক পারবে। বিশ্বাস করুন।’

সেই থেকে শুরু পারুর চাকরি জীবন। পনেরো বছরের বোবা পারু এখন পঁচিশ বছরের যুবতী। লুপ্ত রাজবড়ি যেমন কথা না বলতে পারলেও অবয়বে ধরে রাখে নানান সৌন্দর্যের কারুচিহ্ন। আগত দর্শনার্থী এসে সে রূপ দেখে বিভোর হয়। ছুঁয়ে দেখার তৃষ্ণাবোধ করে পারুর রূপও সেই রকম। ও বোবা বলেই ওর শরীরে সে রূপ আরো বেশি ভাষায়িত ও রেখায়িত হয়ে উঠেছে। তাই কথা বলতে না পারায় নিজের প্রতি ওর আগ্রহ কম থাকলেও শুধুমাত্র রূপের কারণে ওর প্রতি অন্যের আগ্রহের কমতি নেই। চাকরি পেয়ে পারুর শুরু হয় নতুন এক জীবন সংগ্রাম। এতোদিন দাদি তাকে খাইয়েছে পরিয়েছে। এখন সে দাদির দায়িত্ব গ্রহণ করেছে। চাকরিতে জয়েন করার দুইমাস পরে নাসিরাবাদে তার কারখানা হতে আধা কি:মি: দূরে আর একটা কারখানায় চাকরি করা টগরের সাথে পরিচয় ঘটে পারুর। টগরের বাড়ি গাজীপুরের চন্দ্রা। ছোটবেলা মা মারা যাওয়ার পরে বাবা তাকে ঢাকায় একটা এতিমখানায় দিয়ে যায়। এরপর বাবা মোসাদ্দেক মোল্লা তার আর কোনো খোঁজ-খবর নেয়নি। তার বাবা আর একটি বিয়ে করার কথা সে শুনেছিল আরো বছর খানেক পরে। এরও দশ বছর পরে একদিন তার বাবার মৃত্যু সংবাদ পায় সে। এ দশ বছরে মোসাদ্দেক মোল্লা তাকে একটিবারের জন্য দেখতে আসেনি। প্রকৃতি যাকে বোবা করেছে কথা বলার মানবিক অধিকার থেকে যে বঞ্চিত তার প্রতি পিতৃঋণের দায় থাকে না। সে দাবি নিয়ে টগরও কখনো মোসাদ্দেক মোল্লার কাছে দাঁড়ায়নি। এতিমখানাতেই পরিচয় ও বন্ধুত্ব তৈরি হয় বাদলের সঙ্গে। বন্ধুত্ব হরিহর আত্মায় রূপ নেয়। বাদলও এতিম। টগরের পিতা মরার খবর যেদিন এলো তখন তারা কিশোর। সেদিন রাতে তারা দুজন এতিমখানা থেকে পালিয়ে কমলাপুর রেলস্টেশনে এসে চট্টগ্রাম আসার ট্রেন ধরেছিল। চট্টগ্রাম এসে জীবনের রূঢ় বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হয় দুজনকে। প্রথমে একটা জুতো তৈরির কারখানায় কাজ জুটে যায় ওদের। সেখানে দুবছর কাজ করে একটা বিস্কুট তৈরির কারখানায় তিন বছর কাজ করে সেটাও ছেড়ে দেয় ওরা। এরপর বাজারে একটা পুরনো কাপড় বিক্রির দোকানে কাজ পায় টগর। আর নাসিরাবাদ একটা পোশাক কারখানায় চাকরি পেয়ে যায় বাদল। এর আগ পর্যন্ত দুইবন্ধু একই সাথে চাকরি করেছে। এই প্রথম দুজনের দু জায়গায় চাকরি জীবন শুরু হয়। দুজন দুজায়গায় চাকরি করলেও দুজনা চলাচলের সুবিধা এবং বাসাভাড়া কমের জন্য বদ্দারহাটে তারা একসঙ্গে এক রুমের একটা বাসা নিয়ে নেয়। সেখানে  থেকেই দুজন রোজ যাওয়া আসা করে। নাসিরাবাদে পোশাক কারখানায় কাজ নেওয়ার তিনবছর পরে বাদল মালিকের কাছে অনেক অনুনয়-বিনয় করে টগরের জন্য তার কারখানায় একটা কাজের ব্যবস্থা করে ফ্যালে। বছর দুই হলো টগর বাদলদের কারখানায় কাটিং সেকশনে জয়েন করেছে। পুরনো কাপড়ের দোকনে কাজ করতে করতে গত তিন বছরে সে কাপড় কাটার কাজটি মালিকের কাছ থেকে ভালো করে রপ্ত করে নিয়েছে। আজ থেকে দশ বছর আগে কমলাপুর রেল স্টেশন ছেড়ে চট্টগ্রাম এসেছিল টগর। তখন সে কিশোর ছিল এখন সে টগবগে যুবক। স্রষ্টা তাকে ভাষাহীন করেছে বটে, কিন্তু তার চোখ দুটি ভাষাদীপ্ত। ঝাঁকড়া চুলের সুঠাম দেহের অধিকারী  শ্যামাঙ্গের অধিকারী  টগর কথা বলতে পারে না - অপরিচিতদের কেউ এমনটা শুনলে প্রথমে অবাক হয়। পরে টগরকে তারা আপদমস্তক নিরীক্ষণ করে এবং তাদের মুখে একটা অস্ফুট আফসোসের ধ্বনি ‘আহা’ শোনা যায়। টগরের সাথে পারুর পরিচয়ের একমাস পরেই বাদলের চেষ্টায় পারু আর টগরের বিয়ে হয়ে গেল। এর দুই মাস আগে বাদল নাসিরাবাদে তাদের কারখানার সিকিউরিটি গার্ড দেলোয়ারের মেয়ে বৃষ্টিকে বিয়ে করে এনেছে। বাদল চুপচাপ স্বাভাবের হলেও বৃষ্টি চপলা, মুখরা। এই দুই মাসে সে দুই বন্ধুর মধ্যে কেমন যেন সাপের মতো কামনার বিষাক্ত নেশাকে জাগিয়ে তুলতে তৎপর হয়ে উঠেছে। ঘর করে সে বাদলের কিন্তু চোখ থাকে তার টগরের দিকে যেনো। টগর যা মুখ ফুটে চাইতে পারে না, যা বলতে পারে না; যেখানে টগরের সীমাহীন দ্বিধা আর সঙ্কোচ সেখানে বৃষ্টির অবাধ অপরিসীম নিঃসঙ্কোচ বিচরণ। বাদলের রং কালোর দিকে। তবে তা ছাতার কাপড়ের মতো কালো নয়। হ্যাংলা-পাতলা গড়ন। বন্ধু অন্তপ্রাণ মানুষটির কাছে বউ বৃষ্টির আচরণ ক্রমশ দুর্বোধ্য ও রহস্যময় বলে মনে হতে শুরু করেছে। পেটের ব্যথার কথা বলে আজকের বিয়ের অনুষ্ঠানে সে যায়নি। বালিশে মুখ গুঁজে বিছানায় সারাদিন উপুর হয়ে শুয়ে ছিল। বাদল টগরকে দোষারূপ করতে চায় না। টগর পুরুষ মানুষ। হোক সে বোবা। নারীর সাবলীল উপস্থিতি ও সহজাত নিবেদনের ভাষা বোবা পুরুষও বোঝে। তার শরীরেও উদগ্র কামনার বীজ ফোটে। চোখে নেশার মধুরস সৃষ্টি হয়। তার সব কিছু থাকতেও তার বউ কথা বলতে পারে না এমন একজন বোবা মানুষের প্রতি ঝুকলো কেন এটি তার কাছে বড়ই রহস্য মনে হয়। নারী মনের কত খাঁজ, কত তার গোপন কুঠুরি। সব কী পড়া যায় ? আর পুরুষের কাছে সব কী ধরা দেয় ? তার বউ বৃষ্টিই আগুনের উত্তাপ নিয়ে টগরের সামনে হাজির হয়। টগর সে আঁচ থেকে নিজেকে সামলে নেয়ার চেষ্টা করলেও আগুনের ধর্মই হলো তা অন্যের দিকে ধেয়ে আসা। তাই আগুনের কাছাকাছি থাকলে তার ছোঁয়াচ থেকে বাঁচা কঠিন। যে বন্ধুত্ব ভাঙার নয়, হারাবার নয়, বিপন্ন হবার নয় সে বন্ধুকে সংকটের হাত থেকে রক্ষর জন্য বাদল পারুর মতো একটি মেয়েকে খুঁজছিল এবং সেটি মিলেও গেল।

 

আগে দশ বছর দুই বন্ধু চট্টগ্রাম এসে যে যেখানেই কাজ করুক না কেন এক রুমেই থেকেছে। দুইমাস হলো বাদল আলাদা একটা রুম নিয়েছে। বউকে নিয়ে সে সেখানেই থাকে। বাদলের রুমের পাশের রুমটাতে টগর থাকে। টগর বিয়ে করছে বলে টগরের রুমের সাথে লাগোয়া আরো একটা রুম টগরের নামে ভাড়া নেওয়া হয়েছে। যেহেতু এখন থেকে টগরের সাথে পারু এবং পারুর দাদি গুলনাহার থাকবে এই তিনজনের জন্য দুটি রুম। এটা বস্তিপাড়া বাসাগুলো টিনের ছাপড়া। দুটি ফ্যামিলির জন্য একটি করে রান্নার ঘর আর একটি করে বাথরুম। আশপাশের অন্য বস্তিগুলোর তুলনায় এই বস্তিপাড়াটির বসবাসের ব্যবস্থা ভালো। পরিবেশটাও অতো নোংরা এবং অস্বাস্থ্যকর নয়। তবে ধনী বা মধ্যবিত্তের মতো অতো স্বাস্থ্যকরও নয়। বস্থির গা ঘেঁসে একটা পাউরুটির কারখানা ও একটি শুটকি প্রক্রিয়াজাতকরণের কারখানা আছে। শুটকির গন্ধে গা গুলিয়ে যায়। শুটকির গন্ধের নিচে পাউরুটির ঘ্রাণ চাপা পড়ে যায়। অসুবিধের মধ্যে এটুকুই যা অসুবিধে। তবে যারা নিয়মিত থাকে তাদের ওসব গা সওয়া হয়ে যায়। আর এখানকার মানুষেরা বেশিরভাগই নানা পেশাজীবী ও শ্রমজীবী মানুষ। সারাদিন তারা বাইরে কাজ করে।  ঘুমানো ও জৈবিক চাহিদা পূরণের জন্য রাতে তারা ঘরে ফেরে। তাদের সন্তানেরাও সারাদিন ঘরের খোঁজ করে না। বাইরে বাইরে টো টো করে ঘোরে। কুসঙ্গে মেশে, নেশায় আসক্ত হয়। একটু মাথা তোলা হলে যে যার রুটি-রুজির পথ খুঁজে নেয়। দিন শেষে সন্তানদের কে বাসায় ফিরলো, কে ফিরলো না এ নিয়ে বাবা মারা বেশি শংঙ্কিত বা উদ্বিগ্ন থাকে না। তারা ভেবে নেয় আজ না ফিরলে কাল ফিরবে নয়তো পরশু। কোথাও আছে নেশা ভান খেয়ে বন্ধুদের সাথে পড়ে। মরে না গেলে নিশ্চয় ফিরবে। পড়াশোনার ধার তারা ধারে না। এ বস্তির নারী-পুরুষ তাই দৈহিক তাড়নায় ও প্রবৃত্তির নিবারণে মিলিত হয়, নারীর গর্ভে সন্তানও আসে শরীরবৃত্তীয় নিয়মে এবং সে সন্তানের ছন্নছাড়া হয়ে বেড়ে ওঠার প্রক্রিয়াটিও সহজাত নিয়ম বলেই এখানকার বাসিন্দারা মনে করে। শুটকির কারখানা থাকায় এখানে বাসা ভাড়া কম। কনেকে বরের বাসায় নেয়ার জন্য কোনো টমটম, কার বা মাইক্রোবাসের ব্যবস্থা ছিল না। রিকসায় সম্বল। দুটি রিকসা ভাড়া করে চারজন মানুষ চড়ে বসতেই আকাশে মেঘের ডাক শুনতে পেল সবাই। গুলনাহার ও বাদল একটি রিকসায় চড়েছে। অন্যটিতে টগর পারু। রিকসা চলতে শুরু করেছে। নাসিরাবাদ থেকে বদ্দারহাট রিকসা পথ। বাসেও আসা যায়। নতুন বউকে নিয়ে লোকাল বাসে না উঠে টগর রিকসা নিয়েছে। রিকসায় আধা ঘন্টা থেকে পঁয়তাল্লিশ মিনিট সময় লাগে। রওয়ানা দিতে দিতে সাড়ে দশটা বেজে গেল। টগর হাত ঘড়িটা দেখে নিলো রাত পৌনে এগারোটা বাজে। চারিদিক দিয়ে একটা হাওয়া বইছে। রিকসায় হুড তোলা। রাস্তায় গাড়ির সংখ্যাও কমে এসেছে। রাস্তা সুনশান নীরব। মাঝে মাঝে দু একটা সিটি বাস হর্ন বাজিয়ে রিকসার কোল ঘেঁসে চলে যাচ্ছে। হেলপারের কণ্ঠে এই নাসিরাবাদ, চাঁকদা, চকবাজার, স্টেশনরোড ডাক শোনা যাচ্ছে। বাসগুলো যখন তাদের রিকসা ক্রস করছে টগর খেয়াল করলো পারু টগরের বামহাত শক্ত করে জড়িয়ে ধরছে। হয়তো সে ভয় পেয়ে এমনটা করছে। টগর পারুর মাথার উপর ডান হাতটা রেখে স্মিত হেসে ইশারা করে বুঝালো ভয় পেয়ো না আমি আছি। ঘোমটার আড়াল থেকে আঁধারেও যেন বিদ্যুৎ রেখার মতো টগরের মনের কথা বুঝে খুশিতে পারুর চিবুক নড়ে উঠলো। রিকসার ভেতরে দুজনার শরীর দুজনার সাথে পাশাপাশি ঠেসে লেগে আছে। দুজনার শরীর থেকে বের হচ্ছে গাঁদা ফুলের ঘ্রাণ। টগরের ঘরের চাবি বৃষ্টির কাছে রেখে গিয়েছিল। ফুলের দোকানে দুটি ছেলেকে বলা ছিল তারা এসে বৃষ্টির কাছ থেকে চাবি নিয়ে টগরের ঘর খুলে বাসরঘর সাজিয়ে দিয়ে গেছে। কোনটি রুমটি বাসর ঘর হবে টগর তা ছেলে দুটিকে আগেই দেখিয়ে দিয়েছিল। সন্ধ্যার পর ঘর সাজিয়ে ছেলে দুটি বৃষ্টিকে চাবি দিয়ে চলে গেছে। সাজানো শেষ হলে ছেলে দুটি বৃষ্টিকে ডেকে ঘরটা  দেখতে বললে বৃষ্টি প্রথমে রাজি না হলেও ছেলে দুটির অনুনয়-বিনয়ে শেষ-মেশ বিছানা ছেড়ে উঠে গিয়ে সে যখন টগর আর পারুর বাসর ঘরের সামনে দাঁড়িয়েছিল তখন বুকের খুব গভীর থেকে একটা তপ্ত নিঃশ্বাস বের হয়ে এসে তার বুকে তা আছড়ে পড়ে বুকটা যেন পুড়িয়ে খাক করে দিয়েছিল। বাসর ঘর টগর সাজাতে চাইনি। বাদল টাকা দিয়েছে। বাদল সাজিয়ে দিয়েছে টগরের বাসর ঘর। বলেছে বন্ধুর তরফ থেকে এটা বন্ধুর জন্য উপহার। টগর বন্ধুকে বুঝিয়েছিল বোবা মানুষের আবার বাসর কিসের? বাদল শোনেনি টগরের কথা। তার স্বামীর কেনা গোলাপের ভাঁজে ভাঁজে পারুর ভালোবাসার উপাখ্যান রচিত হবে। টগরের ঝঁকড়া চুলে, সুঠাম দেহে  বোবা পারুর দেহের বুদবুদ জাগবে, ভাষার জোয়ারে ভাসবে না। আর সেখানে সেতারের মতোন দেহ সৈষ্ঠবে বৃষ্টি চাইলেই ছিপছিপে ডিঙি নৌকা হয়ে টগরের দেহে ভাবে ও ভাষায় কাম ও প্রেমের বান ডেকে আনতে পারতো। সাড়ে এগারোটায় যখন বর-কনে সমেত বাদল বাসায় পৌঁছালো ততক্ষণে বৃষ্টির চোখ নিদ্রাচ্ছন্ন হয়ে এসেছে। দরজায় কড়া নাড়ার শব্দে সে জেগে উঠে বসলো। জেগে থাকতে থাকতে সে ঘুমিয়ে পড়েছিল। চোখ দুটি তার ভীষণ জ্বালা করছে। পাতা দুটিও ফোলা এবং ভারী। বেশ খানিকটা সময় কেঁদেছেও সে। এ কান্নার কোনো ব্যাখ্যা নেই। দরজার কড়া নাড়ার শব্দে চোখ দুটি কচলে নিল সে। কাক ঘুম এসেছিল সে। চোখ জ্বালা করার পাশাপাশি বুকটাও কেন যেন জ্বলতে শুরু করলো তার। আলাদা কোনো শাড়ি সে পরেনি। সাজগোছও সে করেনি। যাওয়ার সময় বাদল তাকে একটু সাজগোছ করতে বলেছিল। কানটা খাড়া করলো সে। আর একবার দরজার কড়া নড়ার শব্দ শুনলো। তারপর টিনের চালে টিপটিপ বৃষ্টির শব্দ শুনতে পেল সে। বুকের স্খলিত কাপড়টা টেনে বিছানা থেকে নেমে দরজার শেকল খুলেই সে টগর ও পারুকে দেখতে পেল। কোনো প্রেমিক দীর্ঘদিন প্রেম করে প্রেমিকাকে না বলে কয়ে অন্য কোনো নারীকে বিয়ে করে সদ্য বিবাহিতা বউকে প্রেমিকার সামনে হাজির করলে প্রেমিকার মুখের ভাবান্তর যেমনটি হয়, বৃষ্টির চেহারাটাও এই মহূর্তে তেমনটি দেখলো। কোনো নারীর বিধবা হওয়ার সংবাদ নিশ্চিত হলেও চেহারাটা এতোটা ম্লান ও ফ্যাকাশে দেখায় না। দুটি বোবা ভাষাহীন মানুষের বাসর রাতে ভাষার আবেদন নিয়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। যে মনোযন্ত্রণা নিয়ে বৃষ্টির আজ সারাদিন কেটেছে। তার খবর কে রেখেছে ? আহত পাখির মতো তার মনের ছটফটানি তো কেউ দেখেনি। যাকে পাবে না জানলেও সান্নিধ্যটুকু পাওয়া যাবে এতদিন এ নিশ্চয়তাটুকু ছিল। আজ সে সান্নিধ্য পাওয়ার সুখটুকুও খোয়া গেল। আজ সে চিরদিনের মতো পারুর হয়ে গেল। টগরের সাথে তার সম্পর্ক দেবর-ভাবির হলেও বিয়ের আগে টগরের পুরুষ হৃদয়কে সে তার নারী মন দিয়ে একাকী অধিকার-অনধিকারের মাধ্যমে অনেকখানি দখল করে রেখেছিল। অলিখিত সে অধিকারের মধ্যে টগরও খানিকটা বাধা পড়েছিল। নারী সঙ্গহীন বোবা পুরুষ বন্ধুর স্ত্রী জেনেও বৃষ্টির সঙ্গ সবসময় এড়িয়ে যেতে পারেনি। পারু আসার আগে সেখানে ছিল বৃষ্টির একক কর্তৃত্ব ও দখলদারিত্ব। আজ সে দখলস্বত্ব  কড়াই-গণ্ডায় বুঝে নেবে পারু।  বোবা বলে তার এক কানা কড়িও ছাড় দেবে না। বুকের যে জ্বালায় সারাদিন জ্বলছিল বৃষ্টি তাতে ঘি ঢেলে তেজ আরো উসকে দিয়ে সে জ্বালা দ্বিগুণ করে তাকে বধূবরণ করতে হলো না। ঝমঝমিয়ে নামা বৃষ্টি তাকে সে যন্ত্রণা থেকে রক্ষে করলো। কোনো রকমে পরিচয় পর্বটুকু সেরে যে যার মতো দৌড়ে ঘরে উঠে গেল।

 

দুটি বোবা মানুষের বাসর এর চেয়ে আর কী আড়ম্বরতায় হতে পারে ? বাদলের সৌজন্যে সাধারণ একটা চৌকি  গোলাপ ও রজনীগন্ধা দিয়ে সাজানো হয়েছে। পায়ের কাছে জানালাটা বন্ধ রাখা হয়েছে যেন শুটকি কারখানার আঁশটে গন্ধ ভেতরে না ঢুকে পড়ে। তবুও বৃষ্টি ও বাতাসের ঝাপটার সঙ্গে সে গন্ধ গোলাপ ও রজনীগন্ধার সাথে মিশে হলেও দুজনার নাকে এসে খানিকটা ধাক্কা খেল। পারু গন্ধটায় নাক কুচকে টগরের দিকে তাকাতেই টগর বিষয়টি বুঝতে পেরে পারুকে ইশারায় সবটা বুঝিয়ে বলল। গুলনাহার তার ঘরে ঢুকে গেছেন। রাতের খাবার তারা সাথে করে নিয়ে এসেছে। কিন্তু কারো  কোনো খাবার ইচ্ছে নেই। গুলনাহার পোশাক বদলে এসে তাদের সাথে দেখা করে বলে গেলেন। তখন রাত প্রায় পৌনে একটা বাজে। তিনি ঘুমোতে যাচ্ছেন। তিনি কিছু খাবেন না। পারু ও টগরকেও ঘুমিয়ে পড়তে বললেন। বললেন বাইরে বষ্টি হচ্ছে ওদের যদি কোনো কিছু দরকার হয় তবে ওরা যেন তাকে ডাক দেন। কথাগুলো গুলনাহার বলে চলে গেলেন। পারু ও টগর চৌকিতে পা ঝুলিয়ে বসে ছিল এতক্ষণ। পারু ঘোমটা সরিয়ে ইশারায় টগরকে উঠে দাঁড়াতে বলল। টগর উঠে দাঁড়ালে পারু টগরের পায়ে হাত দিয়ে সালাম করে দাঁড়ালে টগর ডানহাত দিয়ে পারুর থুতনিটা উঁচু করে ধরতেই দেখলো পরম আবেশে পারুর চোখ দুটি বোজা। ঠোঁট দুটি ঈষৎ কাঁপছে। এই মুহূর্তে বুকটাও কী দুরু দুুরু করছে পারুর ? পারুকে বুকে জড়িয়ে ধরলো টগর। দুটি বোবা মানুষের জীবনে এর চেয়ে আনন্দের ক্ষণ আর কী হতে পাওে ? সারা বিশ্ব না জানুক এই বৃষ্টি ভেজা রাত আর পারুর খোপার গাঁদা আর ঘরের গোলাপ, রজনীগন্ধরা জানুক আজ ওদের বাসর। কিন্তু জীবন তো এমন নিরবিচ্ছিন্ন সুখের আধার নয়। বিয়ের পর আবার যে যার মতো কর্মব্যস্ত হয়ে পড়ল সবাই। কেবল ব্যস্ততা নেই বৃষ্টির। গুলনাহার বয়স্ক মহিলা হলেও সে নিজে বাজার করে। টগর ও পারুর জন্য রান্না-বান্না করে। সাংসারিক কাজকর্ম করে তার দিন কেটে যায়। মাঝে-মধ্যে বৃষ্টিকে ডেকে নিয়ে বৃষ্টির সঙ্গে গল্প-গুজব করে। তবে সে গল্প-গুজবে বৃষ্টির ভেতরে সাড়া থাকে না। তার মন অন্য কোথাও পড়ে থাকে। রাতে তার স্বামী বাদল, টগর আর পারু বেশিরভাগ দিন একসাথে ফেরে। কখনো কখনো আলাদা ফেরে। তবে টগর ও পারু সব সময় একসাথে আসে। যত রাতই হোক টগরকে এক নজর না দেখলে তার ভোলো লাগে না। সে জানে এটা পাপ। কিন্তু এ পাপ থেকে সরে আসার উপায়ও তার জানা নেই। বিয়ের দুই মাস যেতেই বৃষ্টির ব্যাপারটা বোবা হলেও পারু বুঝে ফেলছে। সে বিষয়টি টগরকে ইশারা ইঙ্গিতে বুঝিয়েছে এবং এ বাসা ছেড়ে অন্যত্র চলে যাওয়া বাসনার কথাও টগরকে জানিয়েছে। টগর বাদলের বন্ধুত্বের কথা বলে পারুকে বলেছে আর দুই-এক মাস সবুর করতে। এর মধ্যে বৃষ্টির আচরণ ঠিক না হলে তারা বাসা পরিবর্তন করবে। তবে বৃষ্টি আগের চেয়ে অনেক নির্লিপ্ত হয়ে গেছে। এখন সে টগরের দিকে কেবল হ্যাংলার মতো চেয়ে থাকে। কথা-বার্তা কম বলে। বাদল এ নিয়ে বৃষ্টির সাথে অনেক কথা কাটাকাটি পর্যন্ত করেছে। তবে ইদানিং বৃষ্টির আচরণ দেখে বাদল মনে মনে ভেবেছে বোধহয় বৃষ্টি নিজের ভুল বুঝতে পেরেছে। বৃষ্টি বোধ হয় ঠিক হয়ে গেছে। কিন্তু বাদলের একথা জানা নেই পরকীয়া প্রেমের ঘুণ একবার যারে ধরে তাকে তা কেটে কেটে নিঃস্ব না করা পর্যন্ত ছাড়ে না। তাই বৃষ্টিও ভেতরে ভেতরে নিঃস্ব হতে শুরু করেছে। টগর ও পারুর বিয়ের দুইমাস পরে একদিন টগরের ভীষণ জ্বর এলো। পারু অসুস্থ টগরকে দাদি গুলনাহারের কাছে রেখে কারখানায় গেল ডিউটিতে। বাদলও সকালবেলা বন্ধুর কাপলে হাত দিয়ে দেখে বলল তোর গা ভালোই গরম। তোর আজ কারখানায় গিয়ে কাজ নেই। আমি ম্যানেজারকে তোর জ্বরের কথা জানিয়ে দেব। বৃষ্টি ও দাদি থাকবে তোর দেখাশোনা করবে। ঘরে কোনো বাজার-সদায় না থাকায় গুলনাহার বৃষ্টিকে টগরের কাছে রেখে বেলা বারোটার দিকে বাজারে গেলে বৃষ্টির এতোদিনের টগরকে ঘিরে অবদমিত কামনা যেন জনমানব শূন্য ঘরটায় বাধ-ভেঙে গেল। গুলনাহার চলে যেতেই সে টগরের জ্বরতপ্ত কপালটা আচমকা চম্বুনে চম্বুনে ভরিয়ে দিতে লাগলো। টগর গোঙরানির মতো একটা শব্দ করে বৃষ্টিকে জ্বরতপ্ত দুর্বল দুহাত দিয়ে সরিয়ে দিতে চেষ্টা করলো কিন্তু বৃষ্টি চিনে জোকের মতো সবলে শায়িত টগরকে দুবাহু ডোরে জড়িয়ে ধরে টগরের বুকে মুখ গুঁজে বলতে লাগলো তুমি এতো পাষাণ কেন? আমার কষ্ট তুমি বোঝ না ? আমার জ্বর তো তোমার বিয়ের দিন থেকে। আমার অন্তর পুড়ে খাক হয় তুমি দ্যাখো না। তোমার বন্ধু আমারে মারে-কাটে। তারপরেও তো আমি তোমারে ভালোবাসি। তুমি কথা কও তুমি আমারে ভালোবাসো না। ওই বোবা মাগী তোমারে কিচ্ছু দিতে পারবো না। আমি তোমারে ভাষা দিব। আশা দিব। সাহস দিব। বল দিব। ভালোবাসা দিব। আমি তোমার বোবা মুখে কথা হবো। চলো এখান থেকে আমরা দুজন পালায়ে যায়।

 

টগর গোঙরানি দিয়েই চলেছে। জ্বরে তার গা পুড়ে যাচ্ছে। সে বৃষ্টির বাহুডোর থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য ছটফট করছে। তার কপলে ঘাম জমেছে। তবুও বৃষ্টি তাকে ছাড়ছে না। হঠাৎ একটা আলাদা গোঙরানির শব্দ শুনে দুজনার চোখ গেল ভেড়ানো দরজার দিকে। দরজা ভেতর থেকে লাগানো ছিল না। ভেড়ানো ছিল মাত্র। দরজা খুলে পারু বিছানায় দুজনকে এমন অবস্থায় দেখে ক্ষিপ্র চিতার মতো বৃষ্টির ওপর ঝাপিয়ে পড়ে বৃষ্টির চুলের মুঠি ধরে ফেললো। চুলাচুলি কাণ্ড যখন শুরু হয়ে গেছে তখন বাজার নিয়ে ঢুকলো গুলনাহার। গুলনাহার বিষয়টা কিছুটা আচ করতে পেরে তখনকার মতো দুজনকে নিরস্ত করলো। টগর অসুস্থ থাকায় পারু ম্যানেজারকে বলে আগে চলে এসে যা দেখেছে তার বর্ণনা ইশারায় দাদিকে বোঝাতে গুলনাহার বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে বললো - ‘ছি বউমা তোমাকে তো আমি ভালো বলে জানতাম। সেই তুমি এমন করতে পারলে। আজ রাতে বাদল আসুক এর একটা বিহিত হওয়া দরকার।’ বৃষ্টি কাঁদতে কাঁদতে ঘরে ফিরে গেল।

 

রাতে বাদল ফিরলে ঘটনা জেনে সে ভীষণ লজ্জিত হলো। টগরের জ্বর এখনো আছে। বন্ধুর জন্য তার কষ্ট হলো। বৃষ্টির জন্য তার করুণা হলো। বৃষ্টিকে কয়েকটা চড় থাপ্পড় দেওয়ার পর মনে মনে ভাবলো আগামীকাল সকালে সে তার বউকে বাপের বাড়ি দিয়ে আসবে। গুলনাহার সাফ জানিয়ে দিয়েছে টগরের জ্বর ভালো হলে তারা এ বাসা ছেড়ে সামনে মাসে অন্যত্র কোথায় বাসা দেখে উঠে যাবে। তবে বন্ধুত্ব তাদের থাকবে। পাশাপাশি বসবাস করবে না এই যা। রাতে বৃষ্টি কোন কিছু খেল না। বাদলের সাথে কথাও বললো না। শুয়ে পড়লো চুপচাপ। বাদল ভাবলো বউকে গায়ে হাত তোলায় রাগ করেছে তাই কথা বলছে না। রাগ পড়লে কথা বলবে ঠিক। তবে অন্য দিনের মতো মারধোরের পরে আজ বৃষ্টি কান্না-কাটি করেনি। কেবল নিরব চোখে বাদলের দিকে চেয়ে ছিল কিছুক্ষণ। রাতে সে চুপচাপ বাদলের পাশে শুয়ে পড়লো।

 

সকালবেলা বাদলের চিৎকারে বস্তির সবার ঘুম ভাঙলো। ঘটনা হলো এই বৃষ্টি শাড়ি পেচিয়ে ফ্যানের সিলিংয়ের সঙ্গে গলায় দড়ি দিয়েছে। ঘরের ভেতরে শূন্যে ঝুলছে বৃষ্টির নিথর দেহটি। মৃত মুখে নেই কারো ওপর কোন রাগ, ক্ষোভ, ঘৃণা। বস্তিবাসী কেউ বুঝতে পারলো না কেন এই আত্মহত্যা? কেবল চারজন ব্যক্তি জানলো এই মৃত্যুর কারণ। একটু বেলা হলে পুলিশ এলো। ডেডবডি নামানো হলো। ময়না তদন্তের জন্য লাশ পাঠানো হলো মর্গে। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য বাদলকে পুলিশ হেফাজতে থানায় নেওয়া হলো। টগর ও পারু বোবা জেনেও পুলিশ টগর, পারু ও তাদের দাদি গুলনাহারকে বাসা থেকে কোথাও না যাওয়ার নির্দেশ দিল। প্রয়োজনে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাদেরকে থানায় ডাকা হবে বলে জানানো হলো। পুলিশ প্রাথমিক তদন্তে ধারণা করলো এটা একটা পরকীয়া প্রেম ঘটিত আত্মহত্যা। কিন্তু তারা বুঝতে পারলো না এই প্রেম কী একতরফা শুধু মেয়েটির দিক থেকে ছিল নাকি বোবা ছেলেটিরও কোনো ধরনের মানসিক সাড়া ছিল ?

 

Sunday, July 4, 2021

এম ডি মনিরের লেখা কবিতা "ভূতুড়ে মহাসড়ক"


ভূতুড়ে মহাসড়ক

এম ডি মনির


থেমে যাক এ মন খারাপের দিন 
নেমে যাক আটকানো ব্যাথার দলা 
এভাবে আর কতদিন হাসি খুশি বিহীন 
স্বাভাবিক হোক আবার জীবনের পথ চলা। 
এমন পৃথিবী চেয়েছিল কি কেউ 
চারিদিকে শুধু আর্তনাদ 
এমন কেন কান্নার ঢেউ 
ভেংগে যাচ্ছে ধৈর্যের বাঁধ।

জনজীবন আজ  ভয়ার্ত চোখে 
ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রয় 
করোনা নামক অদৃশ্য জোঁকে 
সাবাড় করছে জগৎময়।
 
শুনশান নীরবতা 
কোথাও বুঝি কেউ নেই
ঘরবন্দী মানবতা 
হাহাকার সবখানেই।

এম্বুল্যান্সের হুইসেল শুনি 
ভূতুড়ে মহাসড়ক 
উঁকি মেরে মেরে লাশ গুনি 
লেগেছে মানুষের মড়ক!

শরীরের মেদ কমাতে জিরার উপকারিতা


শরীরের মেদ কমাতে জিরার উপকারিতা 


জিরার যে এত জারিজুরি তা কি জানেন? না না, রান্নার কথা বলছি না।ঝোলে-ডালে-অম্বলে,সবেতেই সে আছে। কখনও পাঁচফোড়নে, কখনও তেজপাতার সঙ্গে ফোড়ন দিতে, কখন শুধুই জিরাবাটা, কখনও আবার আদার
সঙ্গে একসঙ্গে বাটা।রান্নায় জিরার ব্যবহার নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নেই। শুধুই যে রান্নায় সুগন্ধের জন্য জিরা ব্যবহার হয়, তা কিন্তু নয়। স্বাস্থ্যের
কথা ভেবেও আমরা রান্নায় জিরা দিই।

স্পাইসি এই মশালা যে আপনার শরীর থেকে বাড়তি মেদ ঝরাতেও ওস্তাদ, সে খোঁজ কি রাখেন? হাতের কাছে ক্যালেন্ডার থাকলে, জাস্ট দিনটি দেখে নিয়ে গোল্লা পাকান।

ধৈর্য ধরে ১৫টি দিন দেখুন। এর মধ্যে রোজ নিয়ম করে এক চামচ গোটা জিরা খেয়ে ফেলুন। একদিনও বাদ দেবেন না। তার আগে আর একটি কাজ আপনাকে করতে হবে।নিজের ওজন নিয়ে, লিখে রাখুন। ১৫দিন পর ফের ওজন নিন। নিজেই অবাক হয়ে যাবেন। কলা দিয়ে জিরা খেলেও ওজন ঝরবে সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গিয়েছে, গোটা জিরা খুব দ্রুত শরীর থেকে ওজন ঝরাতে সক্ষম।

শুধু যে চর্বি বের করে দেয়, তা কিন্তু নয়। একই সঙ্গে অস্বাস্থ্যকর কোলেস্টেরলকে শরীর থেকে বের করে দেয়। ফলে, যারা ওজন কমানোর জন্য জিমে গিয়ে ঘাম ঝরাচ্ছেন, একবার ১৫ দিনের জন্য জিরার ওপর ভরসা রাখতে পারেন। নিরাশ হবেন না। গবেষকরা বলছেন, জিরার মধ্যে রয়েছে থাইমল ও অন্যান্য কিছু
তেলের উপস্থিতি। যার কাজ হলো লালা নিঃসরণকারী গ্রন্থিকে উত্তেজিত করা। যার ফলে খাবার ভালো হজম হয়। এ ছাড়াও জিরার গুণে
পরিপাকতন্ত্র ভালো কাজ করে। গবেষকরা জানাচ্ছেন, হজমের গন্ডগোল হলে, জিরা দিয়ে চা খেয়ে দেখতে পারেন। উপকার পাবেন। এক গেলাস পানিতে এক চামচ জিরা দিন। ভালো করে ফুটিয়ে নিন। পানির রং লালচে হয়ে এলে, গ্যাস বন্ধ করে, পাত্রটি চাপা দিয়ে রাখুন। একদম ঠান্ডা হওয়া অবধি অপেক্ষা করুন। এই জিরা চা দিনে তিন বার খেলে, হজমশক্তি বাড়বে। পেটে ব্যথা কমবে। 
কী ভাবে জিরা খাবেন?
এক: একটা গেলাসে বড় চামচের দু-চামচ গোটা জিরা সারারাত ভিজিয়ে রাখুন। সকালে সেই পানি গরম করে, জিরা না ছেঁকে চায়ের মতো খান। মুখে গোট জিরা পড়লে, ফেলবেন না। চায়ের মতো কয়েক দিন পান করুন, দেখবেন ওজন কমছে।
দুই: যদি দেখেন, উপরের দাওয়াই আপনার ক্ষেত্রে খুব ভালো কাজ করছে না, তা হলে দ্বিতীয় উপায়ের
আশ্রয় নিন। খাবারে জিরার পরিমাণ বাড়িয়ে দিন। দইয়ের সঙ্গেও জিরা খেতে পারেন। ৫ গ্রাম
দুইতে এক চামচ জিরা গুঁড়ো মিশিয়ে নিয়মিত খান।
ওজন নিশ্চিত ভাবেই কমবে। তিন: কয়েক চামচ মধু ও তিন গ্রাম জিরা গুঁড়ো এক গেলাস পানিতে ভালো
করে মিশিয়ে নিন। নিয়মিত এই মিশ্রণটি খান। স্যুপ তৈরি করে, এক চামচ জিরাগুঁড়ো মিশিয়ে খেলেও ভালো কাজ দেবে। চার: পাতিলেবু ও রসুনও ওজন ঝরাতে খুব ভালো দাওয়াই। গাজর ও অন্যান্য
সবজি সেদ্ধ করে নিয়ে, রসুন কুচি ও লেবুর রস ঢেলে দিন। তাতে কিছুটা জিরার গুঁড়ো মেশান। রোজ রাতে
খেয়ে, ম্যাজিক পরিবর্তন দেখুন। ১৫ দিনে পরেই বুঝতে পারবেন আপনার ওজন কমেছে।

 


মাংস রান্নার চার ধরণের রেসিপি




  মাংস রান্নার চার ধরণের রেসিপি


মাংস কে না পছন্দ করে আর যদি মাংস একটু অন্য ভাবে রান্না করা হয় তবে তো কথাই নেই। সব অঞ্চলের মাংস রান্নার ধরণ এক রকমের নয় । তাই আজ আমি চার অঞ্চলের চার ধরণের মাংস রান্নার রেসিপি আপনাদের জন্য দিলাম-----

★খুলনার চুই ঝালের খাসির মাংস ভূনা 

খাসির মাংস ১কেজি
আদা বাটা ১টেঃচামচ
রসুন বাটা ১টেঃচামচ
হলুদ গুঁড়া ২চা চামচ
মরিচ বাটা ১টেঃ চামচ
পেঁয়াজ বাটা ২টেঃ চামচ
পেঁয়াজ কুচি ১/২কাপ
জিরা বাটা ১চা চামচ
ধনে বাটা ১চা চামচ
চুই ঝাল ১০/১১পিস
শুকনা মরিচ ৮টি
জয়ফল বাটা অর্ধেকটি
গরম মসলা গুঁড়া ১চা চামচ
লবঙ্গ ৪/৫টি
এলাচ ৪/৫টি
দারুচিনি ২/৩টুকরা
তেল ১/২কাপ
লবণ স্বাদ মতো
তেজ পাতা ২/৩টি
#প্রণালী----চুলার পাত্রে তেল দিয়ে পেঁয়াজ বাদামি করে ভেজে আস্ত গরম মসলা তেজপাতা দিয়ে একটু ভেজে সব বাটা মসলা দিবো অল্প পানি দিয়ে কষিয়ে তেল উঠলে মাংস দিয়ে ভালো ভাবে নেড়ে ঢেকে রান্না করবো ১০মিঃ যখন দেখবো মাংসের উপর তেল উঠে এসেছে তখন চুই ঝাল , জয়ফল বাটা ,শুকনা মরিচ অল্প চিরে দিবো সব কিছু দিয়ে ভালো ভাবে নেড়ে সিদ্ধ হবার জন্য পরিমাণ মতো পানি দিয়ে ঢেকে রান্না করবো।মাংস সিদ্ধ হয়ে গেলে উপরে গরম মসলা গুঁড়া দিয়ে ভালো ভাবে নেড়ে নিবো।তার পরে গরম গরম পরিবেশ করবো এই মাংসে বেশ ঝাল হয় খেতে।

★নোয়াখালির গরুর মাংসের কালো ভুনা

#উপকরণ ------
গরুর মাংস ১কেজি
আদা বাটা ১টেঃ চামচ
রসুন বাটা ১টেঃ চামচ
পেঁয়াজ কুচি ১কাপ
পেঁপে বাটা ২ টেঃ চামচ
হলুদ গুঁড়া ১চা চামচ
মরিচ গুঁড়া ১টেঃ চামচ
জিরা বাটা ১চা চামচ
মেথি গুঁড়া ১/২চা চামচ
পোস্ত বাটা ১/২চা চামচ
কালো জিরা গুঁড়া ১চা চামচ
গোল মরিচের গুঁড়া ১চা চামচ
জয়ফল ও জয়ত্রী গুঁড়া ১চা চামচ
এলাচ ও দারুচিনি ৮/৯টি
তেজ পাতা ২/৩টি
শুকনা মরিচ ৩/৪টি
গরম মসলা গুঁড়া ১চা চামচ
সরিষার ও সয়াবিন তেল ৩/৪ কাপ
লবণ স্বাদ মতো
রসুন কুচি ১টেঃ চামচ
#প্রণালী------মাংস ভালো ভাবে ধুয়ে অর্ধেক পেঁয়াজকুচি ,আদা,রসুনবাটা,হলুদ,মরিচের গুঁড়া,পেঁপে বাটা,জয়ফল জৈয়ত্রীর গুঁড়া,পোস্ত বাটা,গোল মরিচের গুঁড়া,জিরা গুড়া,এলাচ দারুচিনি তেজপাতা ,গরম মসলা গুঁড়া অল্প তেল সব এক সাথে মাংসের সাথে মিশিয়ে ৩০মিঃ ঢেকে রাখে দিবো।এর পরে চুলায় তেল দিয়ে বাকি পেঁয়াজ দিয়ে বাদামি করে ভেজে মাখানো মাংস দিয়ে ভালো ভাবে নেড়ে ঢেকে রান্না করবো কিন্তু লক্ষ রাখতে হবে যেন লেগে না যায় এই ভাবে বাব বার নেড়ে দিতে হবে মাংসে তেল উঠে এলে কালো জিরা ,মেথি গুঁড়া , দিয়ে ভালো ভাবে নেড়ে ঢেকে রান্না করতে হবে মাংস সিদ্ধ না হওয়া পর্যন্ত প্রয়োজনে অল্প গরম পানি দেওয়া যাবে শেষ অন্য একটি পাত্রে সরিষার তেল দিয়ে তার মধ্যে শুকনা মরিচ ফালি ,রসুন কুচি দিয়ে বাদামি করে ভেজে রান্না করা মাংসে মেশাবো এবার মাংস মাখা মাখা করে ফেলবো ।এই মাংস মাখা মাখা থাকে।শেষে উপরে পেঁয়াজ বেরেস্তা দিয়ে পরিবেশন করবো।

★ সিলেটের সাতকরা দিয়ে গরুর মাংস 

#উপকরণ-----
গরুর মাংস ১কেজি
আদা বাটা ১টেঃ চামচ
রসুন কুচি ১টেঃ চামচ
হলুদ গুঁড়া ১চা চামচ
মরিচ গুঁড়া ১টেঃ চামচ
জিরা বাটা ১চা চামচ
ধনে বাটা ১চা চামচ
জয়ত্রী বাটা ১/২চা চামচ
ভাজা জিরা গুঁড়া ১চা চামচ
সাত করা (ফালি করে কাটা) ৮/৯পিস
এলাচ ও দারুচিনি ৬/৭টি
তেজপাতা ২/৩টি
কালো গোল মরিচ ৫/৬টি
তেল ১/২কাপ
কাঁচা মরিচ ৫/৬টি
লবণ স্বাদ মতো
#প্রণালী------ চুলার পাত্রে তেল দিয়ে তেজ পাতা ,এলাচ,দারুচিনি দিয়ে অল্প ভেজে পেঁয়াজ দিয়ে বাদামি করে ভেজে সব মসলা দিয়ে অল্প পানি দিয়ে ভালো ভাবে কষিয়ে মাংস দিবো এর পরে মসলার সাথে মাংস ভালো ভাবে মিশিয়ে ১০মিঃ ঢেকে রান্না করে মাংসের উপর তেল উঠে এলে আবার পরিমান মত গরম পানি দিয়ে রান্না করবো মাংস সিদ্ধ না হওয়া পর্যন্ত তবে মাঝে মাঝে নেড়ে দিতে হবে ।মাংস প্রায় সিদ্ধ হয়ে এলে সাতকরা ,কাঁচা মরিচ দিয়ে আরো ১০মিঃ রান্না করে শেষ ভাজা জিরা গুঁড়া দিয়ে নামিয়ে নেবো।

★চট্রগ্রামের মেজবানি মাংস রান্না 

মাংস ও কলিজা ১কেজি
আদা বাটা ১টেঃ চামচ
রসুন বাটা ১/২টেঃ চামচ
জিরা বাটা ১চা চামচ
পেঁয়াজ বাটা ২টেঃ চামচ
বাদাম বাটা ১/২ টেঃ চামচ
নারকেল বাটা ১টেঃ চামচ
টেমটো কুচি ১/৪কাপ
হলুদ গুঁড়া ১চা চামচ
মরিচ বাটা ১/২টেঃচামচ
ধনে বাটা ১চা চামচ
জয়ফল ও জয়ত্রী বাটা ১চা চামচ
শাহি জিরা বাটা ১/২চা চামচ
গরম মসলা গুঁড়া ১চা চামচ
গোল মরিচ বাটা ১/২চা চামচ
পোস্ত বাটা ১/২চা চামচ
পেঁয়াজ কুচি ১/২কাপ
সরিষার তেল ১/২কাপ
এলাচ ও দারুচিনি ৬/৭ টি
তেজপাতা ২/৩টি
লবণ স্বাদ মতো
#প্রণালী------হলুদ,মরিচের গুঁড়া,টমেটো কুচি,গরম মসলা গুঁড়া,পেঁয়াজ কুচি, তেল বাদে সব মসলা দিয়ে মাংস ৩০মিঃ মাখিয়ে রেখে দিবো।চুলার পাত্র তেল দিয়ে আস্ত গরম মসলা,তেজ পাতা দিয়ে ভেজে পেঁয়াজ দিয়ে বাদামি করে ভেজে হলুদ,মরিচ গুঁড়া দিয়ে অল্প পানি দিবো তার পরে কষিয়ে মাখানো মাংস দিয়ে ভালভাবে নেড়ে ঢেকে রান্না করবো ১০মিঃ এর পরে টমেটো কুচি দিতে হবে মাংসের উপরে তেল উঠে এলে পরিমার মতো পানি দিয়ে মাংস সিদ্ধ না হওয়া পর্যন্ত রান্না করবো শেষে গরম মসলা গুঁড়া,কাঁচা মরিচ দিয়ে নামিয়ে পরিবেশন করবো।