Saturday, August 14, 2021

গল্পঃ #হায়াত/পর্বঃ ১/ সাহিল রহমান

#হায়াত



পর্বঃ ১

বাংলাদেশের অন্যতম তরুণ নামকরা সায়েন্টিস্ট ডঃ আসফাক, হঠাৎ করেই করেই উধাও হয়ে গেছে। নিজের সকল স্টাডি, রিসার্চ, কনফারেন্স একদম বন্ধ করে দিয়েছে, প্রায় দুমাস হতে চলেছে ইউনিভার্সিটিতে ক্লাস পর্যন্ত নিচ্ছে না। 


আসফাকের স্ত্রী সুমি রোড এক্সিডেন্টে মারা যাবার পরে একদম বিষণ্ণ আর হতাশ হয়ে পরেছে সে, সকলের সাথেই যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছে। 

আসফাকের এভাবে সমাজ থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেবার বিষয়টি তার প্রফেশনাল মানুষজন এবং বন্ধু-বান্ধব সাধারণ ভাবে নিয়েছিল, কারণ আসফাকের জন্য এই শোক মেনে নেয়া যে বেশ কঠিন হবে এটা সবাই জানত। স্ত্রীকে অসম্ভব রকমের ভালবাসত আসফাক, দীর্ঘ দিনের প্রেমের সম্পর্কের পর বিয়ে হয়েছিল ওদের কিন্তু বিয়ের মাত্র এক বছরের মাথায় রোড এক্সিডেন্টে মারা যায় সুমি। 

নিজেকে এই কঠিন পরিস্থিতির সাথে মানিয়ে নিতে এবং ধীরে ধীরে মানুষিকভাবে শক্ত হতে আসফাকের কাছের মানুষগুলো আসফাককে এতদিন একা থাকতে দিয়েছে, সর্বদা খোঁজ খবর নিলেও কেউই আসফাককে খুব বেশী ঘাটায়নি, কিন্তু আজ আসফাক যেটা করছে সেটার পর আসফাকের সাথে সরাসরি কথা বলাটা বেশ জরুরী, এটাকে পাগলামো ছাড়া আর কিছুই বলা যাবে না…


~


ঢাকা ইউনিভার্সিটির কোয়ান্টাম মেকানিক্সের বিভাগীয় প্রধান নূর হক নিশ্চুপ হাতে দুটি কাগজ ধরে বসে আছেন, টেবিলের উপর সাদা খোলা খামটা কিছুক্ষণ আগে তার উদ্দেশ্যে এসেছে, যেই খামটা এখনো ফ্যানের বাতাসের সাথে সাথে হালকা দুলছে, খামটা খোলার পর নূর হক যেটা পড়লেন সেটা পড়ে মারাত্মকভাবে মর্মাহত হয়েছেন তিনি। 

খামের মধ্যে দুটো কাগজের মধ্যে একটি আসফাকের পদত্যাগ পত্র আর আরেকটি ছোট একটি চিঠি, যেখানে লেখা, 


“স্যার আমাকে আপনি ক্ষমা করবেন, আমার পক্ষে ক্লাস আর রিসার্চ চালিয়ে যাওয়া সম্বব নয়, আমি সমাজ হতে দূরে চলে যাচ্ছি, হয়ত আপনাদের সাথে আর দেখা হবে না, হয়ত হবে… 

আগামীতে কি হবে, জানি না… 

আর জানার কথাও না… 

মানুষের জীবন, সময়ের মতনই অনিশ্চিত…”


চিঠির শেসে আসফাক তার নাম উল্লেখ করেনি, আর নাম উল্লেখ করার কোন প্রয়োজনও নেই। আসফাকের হাতের লেখা নূর হক খুব ভাল করেই চেনেন। চিঠিটা শেষ করার কিছুক্ষণ পরে দুটি নম্বরে কল করলেন নূর হক, যদিও তিনি জানেন এতে কোন লাভ হবে না, আসফাক যেই সিধান্ত নিয়েছে, সেটা সে করবেই, তাকে সেখান থেকে কেউই ফেরাতে পারবে না। তা না হলে আসফাক সরাসরি নূর হককে চিঠি লিখত না… 


~


সুমির বাবা আর আসফাকের বন্ধু বদি, নূর হকের ফোন পাবার পর দ্রুত ছুটে যায় আসফাকের বাসায়, কিন্তু ততক্ষণে আসফাক তার ফ্ল্যাট ছেড়ে চলে গেছে, কোথায় গেছে সেটা জানে না কেউই। ফ্ল্যাটের চাবি আসফাকের শ্বশুরের কাছে থাকার কারণে সহজে দরজা খুলে প্রবেশ করল ওরা কিন্তু সেখানে আসফাককে দেখা গেল না। 

আসফাক আর সুমির সাজানো ফ্লাটটা খাঁ খাঁ করছে, মেয়েকে হারিয়ে সুমির বাবা কষ্ট পেলেও মেয়ের জামাই এর এমন মানুষিক অবস্থায় বেশ ভেঙ্গে পড়লেন তিনি, ঠা হয়ে দাড়িয়ে রইলেন  আসফাকের বাড়ির সামনের ঘরের আলনা ধরে। 


আসফাকের বন্ধু বদি পাগলের মতন সমস্ত ঘর আসফাককে খুঁজে বেশ সময় পর হাঁপাতে হাঁপাতে হাজির হল সামনের ঘরে, লক্ষ্য করল সুমির বাবা দিশেহারা নজরে তাকিয়ে আছে সামনের দিকে, একটি মৃত্যু কিভাবে তছনছ করে ফেলল দুটি পরিবার, এই ভেবে বুকের মধ্যে চিনচিন এক ব্যাথা অনুভব করল বদি… 


~

সুমি আসফাকের জন্য শুধু মাত্র প্রেমিকা বা স্ত্রী ছিল না, সুমি ছিল আসফাকের জন্য জীবন। সুমি ছাড়া নিজেকে কোনোদিনও চিন্তা করতে পারে না আসফাক আর পারবেও না। ছোট কালে বাবা-মা হারানো অনাদরে বড় হওয়া আসফাকের মরুভূমিময় জীবনটায় সুমিই ছিল এক মাত্র বৃক্ষ। ভার্সিটির প্রথম দিন সুমির সাথে দেখা হবার পর হতে আসফাকের সাথে বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল তার, সেদিনের পর আসফাকের সকল কষ্ট নিজের করে নিয়েছিল মেয়েটি। জীবনটা একদম বদলে দিয়েছিল, আজকে আসফাকের এই নাম, এই খ্যাতি সমস্ত কিছুর পেছনে লুকিয়ে আছে সুমির অবদান। আসফাক কে বিয়ে করার জন্য নিজের বাবা মায়ের সাথে রিতিমতন যুদ্ধ করেছিল এই সুমি। 


কিন্তু আজ আসফাক কে একা রেখে চলে গেছে সে, চলে গেছে না ফেরার জগতে। সুমির নিজ হাতে সাজানো এই ঘরে বসে বসে দীর্ঘ দুই মাস ধরে চিন্তা করেছে আসফাক, আর এই চিন্তা থেকেই এই সিধান্তে উপনীত হয়েছে সে। আর তা হল আসফাক সুমিকে ফিরিয়ে আনবে, আর তাই সকল মানুষ আর সমাজ থেকে হারিয়ে যেতে হবে তাকে… 


আসফাক খুব ভাল করেই জানে পৃথিবীর বাঘা বাঘা বিজ্ঞানী টাইম ট্রাভেল করতে ব্যর্থ হয়েছে, কিন্তু আজও পৃথিবীতে এই চেষ্টা বিদ্যমান। সুমিকে ফিরিয়ে আনতে হলে এটা ছাড়া আর কোন উপায় নেই আসফাকের কাছে, প্রয়োজনে সে জীবনের শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত চেষ্টা চালিয়ে যাবে । আর সেই চেষ্টা করতে বাংলাদেশের কোয়ান্টাম মেকানিক্সের নামকারা তরুণ সায়েন্টিস্ট রওনা হয় গহীন অজানা এক স্থানের উদ্দেশ্যে…


~


২৭ বছর পর… 


মফস্বল শহরের কাছেই ছোট একটি গ্রাম পাইকাল, এখানের সহজ সরল সকল মানুষ আসফাককে পাগল মেকানিক হিসেবেই চেনে, এই মানুষটার সারা বাড়ি ভর্তি শুধু অগোছালো বিভিন্ন রকমের সরঞ্জাম, যেগুলোর মাথা মুণ্ডু কিছুই বোঝে না তারা। কিন্তু এই গ্রামের মানুষগুলো খুব ভালোবাসেন আসফাক নামের পাগল মেকানিক কে। বিভিন্ন সরঞ্জাম ব্যাবহার করে গ্রামের মানুষের জিবিন খুব সহজ করে তুলেছে এই পাগল মেকানিক। 


আসফাকের এই গ্রামে আসার প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে আসফাকের পরিকল্পনা নিয়ে মাথা ঘামানোর কেউই নেই এই গ্রামে, ওদের কাছে আসফাক  একজন পাগল মেকানিক ছাড়া আর কিছুই না। 


এতটা বছর এই গ্রামে থেকে গ্রামের মানুষের সাথে বেশ সৌহার্দপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি হলেও আসফাকের এখান থেকে যাবার সময় হয়ে এসেছে, আসফাকের উদ্দেশ্য আজ প্রায় সফলের পথে, দীর্ঘ ২৭ বছর গবেষণার ফসল টাইম ট্রাভেলের যন্ত্র আজ তৈরি, আসফাক এবার ফিরে যাবে ঠিক ২৭ বছর পেছনে, সেই দিন যেদিন মর্মান্তিক এক গাড়ি দুর্ঘটনায় মৃত্যু বরণ করেছিল আসফাকের স্ত্রী সুমি। সেদিনের স্মৃতি আসফাকের চোখে আজও জ্বলমান, 


সুমির বাড়িতে সুমির বাবার সাথে দেখা করে আসার পথে বাসের সাথে ধাক্কা খেয়ে ছিটকে পড়ে আসফাকের গাড়ি। আসফাক বেচে গেলেও সুমি বাঁচে নি। সেদিন আসফাক দুই বার করে সুমিকে বাপের বাড়ি থেকে যাবার কথা বলেছিল, কিন্তু সুমি শোনে নি। এবার এই ভুল আর করবে না আসফাক, এবার সুমিকে তার বাবার বাড়িতে রেখে আসবে সে। আর সেই সাথে চিরতরে পরিবর্তন হয়ে যাবে আসফাকের জীবন। সুমির সাথে আবার শুরু হবে আসফাকের সংসার।


ঘড়িতে ঠিক রাত ৮ টা বেজে ৪০ মিনিট, নিজের হাতে তৈরি যানে বসে সমস্ত কিছু একবার দেখে নিল আসফাক, তারপর হাতের সামনে লাল বোতামটি চেপে ধরল, সেই সাথে এক আলোর ঝলকানিতে হারিয়ে গেল সে। 


~


চোখ খুলে তাকাল আসফাক, সে কতক্ষণ বেহুঁশ ছিল সেটা সে নিজেও জানে না, কিন্তু আসফাক যে সঠিক সময়ে সঠিক স্থানে এসেছে এটা নিশ্চিত, নিজে এই যানে ওঠার আগে জড় বস্তু সহ কিছু প্রাণীকে অতীতে পাঠিয়েছে আসফাক, ওদের দেখে এটা নিশ্চিত হয়ে গেল সে। বুক ভরে নিঃশ্বাস নিয়ে মৃদু হাসল আসফাক, সে এই মুহূর্তে ২৭ বছর পূর্বের অতীতে অবস্থান করছে, আজ রাত ৯ টা ৩০ মিনিটের আগেই নিজের কাজ সম্পূর্ণ করতে হবে আসফাক কে। 


ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দ্রুত নিজের আসল কাজের উদ্দেশ্যে রওনা করল আসফাক। 


~


সুমির বাসার নিচে গিয়ে প্রথমে নিজ গাড়ির টায়ার পানচার করল আসফাক, তারপর একটি অজানা নম্বর হতে নিজ নম্বরে কল করল সে। 


সুমির সাথে রাতের খাবার খেয়ে সুমির বাবার সাথে গল্প করছিল আসফাক, গল্পের ফাকে দুই বার আসফাক সুমিকে বলল, এই তুমি চাইলে আজ এখানে থেকে যাও, আমার কোন সমস্যা হবে না। 


আসফাকের কথায় সুমির একই উত্তর, আরে না, যাই , আজ বাসায় অনেক কাজ পড়ে আছে। সুমিকে আর কিছু বলল না আসফাক, সুমি বাড়িতে এলেই আসফাকের জন্য ভাল, একা বাড়িতে ভাল লাগে না তার। ঠিক এই সময় একটি অচেনা নম্বর হতে ফোন পেয়ে ফোনটা ধরল আসফাক, ফোনের ওপাশের কথা শুনে মুহূর্তেই ভ্রু কুঁচকে গেল তার, কেমন যেন পরিচিত একজন বয়স্ক মানুষের গলা, 


লোকটা গড়গড় করে কিছু কথা বলল, যার প্রথম কথাটা ছিল, 

“তোমার ল্যাবের পাসওয়ার্ড ***** যেটা তুমি ছাড়া কেউ যানে না, এমনকি সুমিও না। তার মানে বুঝতে পারছ আমি কে, আমি আসফাক ২৭ বছর ভবিষ্যৎ হতে ছুটে এসেছি সুমিকে বাঁচাতে। আজ রাত ৯.৩০ মিনিটে গাড়ি দুর্ঘটনায় মারা যাবে সুমি, সুতরাং সুমিকে তুমি আজ এখানেই রেখে আসবে। তুমি যদি আমার কথা বিশ্বাস না কর সেজন্য তোমার গাড়ির চাকাটা পানচার করে দিয়েছি আমি, এখন রাখি, আমার হাতে সময় কম!” 


ফোনটা কেটে যাবার পর কিছুক্ষণ একদম হতভম্বের মতন চুপ করে বসে রইল আসফাক, তারপর নিজেকে সামলে উঠে দাঁড়াল সে, আসফাক কে উঠে দাড়াতেই সুমি বলল, “কি হল, দাঁড়ালে যে, কোথায় যাচ্ছ ?”

সুমির দিকে তাকাতেই কলিজা কামড়ে উঠল আসফাকের, কিছুক্ষণ আগে ফোনে বলা সেই মানুষটার কথাটা মনে হয়ে গেল তার। 


সুমির প্রশ্নে খুব দ্রুত উত্তর দিল আসফাক, “সুমি, শোন, আজ তোমাকে এখানেই থাকতে হবে, বদি ফোন করেছিল, ওর  মায়ের শরীরটা খারাপ, ওর বাসায় যেতে হবে।” 


“কি হয়েছে বদির মার…” এটুকু বলার পরেই সুমিকে থামিয়ে দিল আসফাক,  “তেমন কিছু না… আমি যাই হ্যাঁ… 

আগামীকাল ভার্সিটি থেকে ফেরার পথে তোমাকে নিয়ে যাব…” 

এটুকু বলেই সুমির বাবার বাসা হতে বের হয়ে গেল আসফাক, গাড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়াল, দেখল সামনের দুটো চাকাই পানচার, নিশ্চুপ হয়ে আরও কিছুটা সময় গাড়ির সামনে দাড়িয়ে থেকে, বের হয়ে রাস্তায় এল। এদিক সেদিক তাকাল কয়েক বার। কাউকেই দেখা যাচ্ছে না। কিছুক্ষণ আগের ফোনটা সম্পূর্ণ মাথা জ্যাম করে দিয়েছে। কিন্তু  লোকটা যেই পাসওয়ার্ড বলেছে সেটা সঠিক, এটা যে আসফাক ছাড়া আর কেউই জানে না সেটাও সঠিক। 


একটা সি.এন.জি ঠিক করে উঠে বসল আসফাক, দূর হতে আসফাকের দিকে বাইনুকুলার দিয়ে তাকিয়ে রইল ২৭ বছর ভবিষ্যৎ হতে আসা আসফাক নিজেই, লক্ষ্য করল আসফাকের সাথে সুমি নেই। তারমানে সুমি তার বাবার বাড়িতে থেকে গেছে। মনের মধ্যে অস্থিরতা কমে আসল আসফাকের, সে ধীরে ধীরে সঠিক সময়ে যাবার জন্য তৈরি হতে থাকল। জীবন এখন পরিবর্তন হয়ে যাবে সেই আশায়… 


~


সেদিন গভীর রাত পর্যন্ত ঘুমাতে পারল না আসফাক, কোয়ান্টাম মেকানিক্সের বই গুলো বারবার করে দেখল সে, সময় ভ্রমণ কি সত্যিই সম্ভব ! যে ফোন করেছিল সে কি সত্যিই ভবিষ্যৎ হতে এসেছিল? এমন কিছু বিক্ষিপ্ত চিন্তা করতে করতে একটা সময় চোখ লেগে আসল আসফাকের। আর তারও কিছুক্ষণ পর মোবাইলের ফোনের শব্দে ঘুম ভাঙ্গল তার, সুমির বাবা ফোন করেছেন, এত রাতে সুমির বাবার ফোন পেয়ে সামান্য অপ্রস্তুত হয়ে ফোন ধরল আসফাক, ওপাশের কথা শুনতেই বুক ধড়ফড় করে উঠল, 


“আসফাক… বাবা তুমি দ্রুত ঢাকা মেডিকেলে আস, ঘরের সিলং ফ্যান খুলে সুমির মাথায় পড়েছে, অবস্থা ভাল না…” 

সুমির বাবার কান্না জড়িত গলা শুনে চারপাশ অন্ধকার হয়ে আসতে লাগল আসফাকের… 


চলবে… 


লেখকঃ Sahel Rahman

No comments:

Post a Comment

Thank u very much